অনলাইন জুয়ায় সর্বস্বান্ত যশোরের তরুণ সমাজ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © সংগৃহীত

মুঠোফোনের পর্দায় কয়েক সেকেন্ডের লোভনীয় জয়ের স্বপ্ন, আর তার আড়ালে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জীবনের করুণ বাস্তবতা—যশোরে অনলাইন জুয়া ক্রমেই রূপ নিচ্ছে নীরব সামাজিক বিপর্যয়ে। এই আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে তরুণের জীবন, ধ্বংস করছে পরিবার ও ভবিষ্যৎ, আর আইনগত নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিনই বাড়ছে এর ভয়াবহ বিস্তার।

যশোর সদরের চুড়ামনকাটির জাহিদ আবদুল্লাহ সিফাত পেশায় ফার্মাসিস্ট ছিলেন। বছর দুয়েক আগে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ধীরে ধীরে তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। সেই হতাশা থেকে গত ২১ নভেম্বর রাতে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এই তরুণ। 

এর তিন দিন আগে সদর উপজেলার নোঙরপুর গ্রামের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জিহাদ হোসেনের মোবাইল ফোনটি নষ্ট হয়ে যায়। অনলাইন গেমে আসক্ত জিহাদ নতুন মোবাইল কেনার জন্য জিদ ধরে। কিনে দিতে দেরি হওয়ায় গত ১৮ নভেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন এই তরুণও।

কেশবপুরের ইকরামুল কবির পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। গেল তিন বছর তার ব্যবসায় মন্দা চলছিল। অর্থ সংকটে পড়েন তিনি। অর্থাভাব কাটাতে এ সময়ে বন্ধুদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন কবির। তবে ভাগ্য সহায় হয়নি তার। উল্টো আরও প্রায় ১৮ লাখ টাকা দেনার বোঝা কাঁধে চাপে।

শুধু সিফাত কিম্বা ইকরামুলই নন, অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন সম্পর্কে সাধারণের অনভিজ্ঞতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অসচেতনতা, দুর্বল আইন ও প্রয়োগের কারণে এর আসক্তি শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ গেল সাত মাসে যশোরে এ-সংক্রান্ত মাত্র ছয়টি মামলা হয়েছে।

যশোর জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. শামীম আহমেদ চৌধুরী জানান, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ধারা ২০ অনুযায়ী অনলাইন জুয়া খেলা, জুয়া সংক্রান্ত অ্যাপ বা পোর্টাল তৈরি ও প্রচারণা চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের জন্য দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। আইনে সাইবার স্পেসে জুয়া কিংবা অনলাইন জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অথচ এই ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ একেবারেই সীমিত। যশোর শহর ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের যেকোনো হাট-বাজারে সন্ধ্যানাগাদ গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন, কিশোর-তরুণ-যুবাদের অনেকেই বুঁদ হয়ে আছেন মোবাইল ফোনে। কাছে গেলে বোঝা যায়, তাদের বড় অংশই অনলাইন জুয়া খেলছে।

গুগলের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত দেশে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা রংপুর বিভাগের মানুষ। ইন্টারনেটে এই ক্যাসিনোর সাইট সার্চের রেটিং স্কোর ১০০-এর মধ্যে ১০০। রাজশাহী বিভাগ রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে যার স্কোর ৪৬। এরপর চট্টগ্রাম ৪১ এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সমান ৩৬ স্কোর রয়েছে।

যশোর সনাকের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহীন ইকবাল বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের কারণে অনলাইন জুয়ায় আসক্তির ঘটনা বাড়ছে। অনেকটা মাদকের মতোই যা শহর-গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তরুণ-যুবকরা লোভে পড়ে ভ্রান্ত এ পথ বেছে নিচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বেকার তরুণ-যুবকদের কর্মমুখী শিক্ষার অধীনে এনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে। সেইসাথে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সর্বমহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা মোহে পড়ে তরুণ ও যুবসমাজ ভ্রান্ত এ পথটি অনুসরণ করতে থাকবে।’

বাংলাদেশে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই যে কারও সামনে হাজির হয় দেশি কিম্বা বিদেশি জুয়ার মনোলোভা বিজ্ঞাপন। আকৃষ্ট হয়ে যে তরুণ একবার এই সাইটে প্রবেশ করে, ক্রমে সে আসক্ত হয়ে ওঠে জুয়ায়।

গুগলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েকশ জুয়ার সাইট চলমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে, ক্রিকায়া ডটআইও, ক্রিকায়া ডটবেস্ট, দারাজপ্লে ডটভিআইপি, বাংলাবেটস ডটকম, নগদ৮৮ ডটপ্রো, জিটাউইন ডটকম, বি৯৯৯স্নো, খেলা৮৮ ডটঅনলাইন, নগদ৮৮ ডটকম, বাবু৮৮এইচ ডটকম, বাবু৮৮এফ ডটকম, উইন-বিডিটি ডটকম, এমসিবাংলাদেশ ডটওআরজি, জেরেমিথ ডটকম, ক্রেজিটাইম৮৮ ডটঅ্যাপ, সিএসওয়েলকাম ডটকম, বাংলাবেট ডটনেট, বাবু৮৮বিডিটি ডটকম, ১উইনবাংলাদেশ ডটকম, বাবো৮৮ ডটকম, বিকে৩৩ ডটনেট, এল৪৪৪ ডটওআরজি, স্লটএম৭৭ ডটকম, জয়া৯৯ ডটকম, ৭৭৭জয়া ডটনেট, টিকে৯৯৯ ডটওআরজি, ধোনি৮৮ ডটকম, বিগটাকা ডটকম, মোস্টপ্লে ডটভিআইপি, ফ্যানসিউইন ডটকম, গ্লোরিক্যাসিনো ডটকম, জেডব্লিউ ডটক্যাসিনো, ক্যাসিনো ডটওআরজি ইত্যাদি।

সম্প্রতি টিআইবির এক গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেই দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। যা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ই-ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার হয়।

এসব অনলাইন জুয়ার অ্যাপের বেশির ভাগই রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পরিচালনা করা হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলোর স্থানীয় এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে টাকা আদান প্রদান করেন। আবার এই এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটসহ দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতা খুবএকটা দৃশ্যমান না।

ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, মূলধারার সম্প্রচার মাধ্যমে আইপিএল, বিপিএলসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় খেলা সম্প্রচারসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেটিং সাইটের চটকদার বিজ্ঞাপন ভিন্ন মোড়কে বা ‘সারোগেট’ বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কিম্বা আইন প্রণয়নের পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্পোর্টস চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপনের রমরমা প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে।

যশোর জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, অনলাইন জুয়ার ব্যাপকতা ও ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় আইনটির দণ্ড অনেকটাই কম; যা অপরাধীকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য তেমন সহায়ক নয়। এতে আইনের ফাঁকফোঁকর গলে অপরাধীর বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত যশোর শহরের মিঠুন হোসেন, সজীব হাসান, হৃদয় দেব, এনামুল কবির, সান্টুসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এদের মধ্যে শুধুমাত্র মিঠুন হোসেন ছাড়া অন্যরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এমন নেশাসক্ত হয়ে সজীব ও এনামুল জমি বিক্রির মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন।

আইটি স্পেশালিস্ট খালেদ ইমরান রিপন জানিয়েছেন, জুয়া কর্তৃপক্ষ সার্চ হিস্ট্রি পর্যবেক্ষণ করে সেই এলাকার এক বা একাধিক ব্যক্তিকে মুনাফা প্রদান করে থাকে। এতে লাভবান ব্যক্তিরা এলাকায় ‘আইডল’ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এ থেকে উৎসাহিত হয়ে অন্যরাও একই পথে হাঁটে। এটি একটি ‘মাইন্ড গেম’, যা ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় মানুষকে সহজেই বিপদগ্রস্ত করে। এখানে বাংলাদেশের মানুষের আইটি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতাও এজন্য অনেকাংশে দায়ী।

‘সাইবার জুয়া কোম্পানিগুলো মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংক, ফাইন্যান্সিয়াল হাউস কিংবা পেমেন্ট গেটওয়ে ইত্যাদির সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড। দেখবেন, মাসের পর মাস নির্দিষ্ট কিছু পুলের মোবাইল ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ইরেগুলার, একমুখী এবং অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে। একটা পুল অফ নম্বরে টাকা যাচ্ছে, সেটা নির্দিষ্ট নম্বরে গিয়ে ক্যাশ আউট হয়ে বাইরে পাচার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে অপরাধীদের চিহ্নিত করা সহজ হবে,’ সুবর্ণভূমিকে বলছিলেন খালেদ ইমরান।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আমিনুর রহমান জানান, আর্থিক অনিরাপত্তা মানুষকে দ্রুত হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। আর তা থেকে উত্তরণের জন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তি সহজ পথ বেছে নিতে চান। জুয়া তেমনি সহজ পথ হওয়ায় সেদিকেই বেশি ঝুঁকছে মানুষ। আর অনলাইনে তা আরও সহজলভ্য। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার জানান, গেল সাত মাসে যশোর সদর, ঝিকরগাছা ও কেশবপুরে দুটি করে এ সংক্রান্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। ওই মামলার ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছিল। যাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনলাইন জুয়ার মূল এজেন্টদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!