কাতি গেলো, আগুন এলো: হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ উৎসব বিলুপ্তির পথে

লোক উৎসব
লোক উৎসব  © সংগৃহীত

বাংলার গ্রামীণ জীবনে মাসের পালাবদল শুধু ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন তেমন না হলেও  ছিল লোকমুখে বিশ্বাস, আচার, উৎসব আর আনন্দ উল্লাসে ভরা এক সাংস্কৃতিক চিহ্ন। সেই ধারাবাহিকতারই একটি  অংশ হলো কার্তিক শেষ, অগ্রহায়ণ শুরুর দিনটিকে ঘিরে গ্রামে যেভাবে উৎসবের বাতাস বইত, আজ তা প্রায় বিলুপ্তির পথ ধরে।

কার্তিকের শেষ বিকেল মানেই ছেলে মেয়েদের  দল বাশের মাথায় খড়-বোঝা ভরে বানাতো ভোলা বা বইড়ো। সন্ধ্যা নেমে এলে আগুন জ্বালানো মশালের আলোয় দৌড় শুরু হতো গ্রামের মাঠ আর পথ জুড়ে।

চারদিকে শোনা যেত পরিচিত স্লোগান

'কাতি গেলো আগুন আইলো,

করাকড়ির মা দোয়ারে বইলো'

কারও মুখে আঞ্চলিক ভাষা, কারও মুখে চিৎকার করে উচ্চারণ। সব মিলিয়ে এ ছিল অন্ধকার তাড়ানোর, অশুভ শক্তি দূর করার এবং নতুন মৌসুমকে স্বাগতম জানানোর এক প্রাচীন রীতি।

লোকবিশ্বাসে কার্তিক মাসকে ধরা হতো দুর্ভিক্ষ, রোগবালাই ও সংকটের সময়।ফসলের ঘাটতি, কাজের কম সুযোগ আর দীর্ঘ খরা সব মিলিয়ে মানুষের মনে ভয় ছিল এই মাসটিকে ঘিরে।

তাই কার্তিকের শেষ রাতে আগুন জ্বালানো ছিল অশুভ শক্তি দূর করার প্রতীকী আয়োজন।

অন্যদিকে অগ্রহায়ণ ছিল ধান কাটার মাস, সমৃদ্ধির বার্তা

ফসল ঘরে ওঠার আশায় মানুষ উদ্দীপ্ত থাকত।

সেই কারণে বলা হতো 'কার্তিক গেলো আগুন আইলো, কইরা পুটি মাছ দোয়ারে পড়লো…' অর্থাৎ দারিদ্র্যের মাস শেষ, এখন খাবার–ফসল–সমৃদ্ধির দিন।

আজ অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এ আয়োজন কি শিরক বা কুসংস্কার?

লোকবিশ্বাস গবেষকদের মতে এগুলো মূলত গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির অংশ,

অশুভ–রোগ–অভাব দূর করার প্রতীকী রীতি। এতে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই—বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রকাশ।

যারা একসময় গ্রামের মাঠে আগুন নিয়ে দৌড়েছে— আজ শহরে বা ব্যস্ত জীবনে তারা সেই স্মৃতি ভুলতে পারে না।

 অনেকে বলেন, এখন আর ছেলে মেয়ারা ফোন ছাড়া কিছুই জানে না।গ্রামে মানুষ একসাথে হয় না—আগের আনন্দ নেই।

 আজ সেই উৎসব অনেক অঞ্চলে একেবারেই হারিয়ে গেছে।

টিমটিমে আলোয় ভরা গ্রামের সন্ধ্যা,

শিশুদের চিৎকার–দৌড়, বড়দের হাসিমুখে দেখাশোনা—সবই সময়ের সঙ্গে মুছে যাচ্ছে।

তবুও কিছু এলাকায় এখনো দেখা যায় এই রীতি, অভ্যাস থেকে নয়, স্মৃতি টিকিয়ে রাখার তাগিদে।

কার্তিকের শেষ রাতের আগুন শুধু লোকবিশ্বাস বলা যায়না এ ছিল অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াই, সংকটের পর আশার শুরু। আজ সেই বিস্মৃত উৎসব আমাদের শৈশবকে স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে ছিল না মোবাইল,ছিল মাটির গন্ধ, আগুনের আলো, আর একঝাঁক কিশোরের ছুটে চলা।


সর্বশেষ সংবাদ