হাসপাতালে রাতে মেলে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা, রোগীদের ভরসা ইন্টার্ন ও ঝাড়ুদার
- রুহুল আমিন, যশোর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৬ AM
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রাতের বেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের খুঁজে পাওয়া যেন দুষ্কর। ফলে সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা রাতের বেলা কার্যত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রোগীদের ভাষ্যমতে, এই সময় চিকিৎসকের ভূমিকায় দেখা যায় ইন্টার্ন, ওয়ার্ডবয়, আয়া এবং ঝাড়ুদারদের। এছাড়াও, শুক্রবার কোনো কনসালটেন্ট বা সহকারী রেজিস্ট্রারকে হাসপাতালের আশেপাশেও দেখা যায় না।
এই হাসপাতাল কেবল যশোর নয়, পাশ্ববর্তী নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার বহু রোগীর জন্যও শেষ ভরসাস্থল। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার আশায় আসা রোগীরা নানা ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। যদিও বিভিন্ন বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন, কিন্তু তারা নিয়মিত রাউন্ডে না আসায় রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। সাধারণত সকালে একবার রাউন্ড দিলেও, তা হয় তড়িঘড়ি করে, রোগীদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলার সুযোগও থাকে না। ফলে তারা চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় অনেক রোগী বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে চলে যান, যার ফলে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার ও ক্লিনিক ব্যবসা বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রোগী রফিকুল ইসলামের স্বজন জানান, সকালে চিকিৎসকেরা দলবদ্ধভাবে রাউন্ডে এলেও তাড়াহুড়া করে চলে যান। রাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখা মেলে না। পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ ধরে ভর্তি তার রোগীর ফলোআপে রাতের বেলা কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেননি। রাসেল, বৃষ্টি, পারভীনা ও আশাদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন রোগীর স্বজন একই ধরনের অভিযোগ করেন।
গত কয়েকদিনে পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, ছুরিকাঘাত কিংবা মারামারিতে আহত হয়ে অনেক রোগী ভর্তি হন। কিন্তু এসব গুরুতর রোগীদের দেখভালের দায়িত্ব ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর পড়ে। সহকারী রেজিস্ট্রার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা না এসে মোবাইল ফোনেই চিকিৎসা পরামর্শ দেন। এভাবে গত এক সপ্তাহে ২২ জন রোগীকে খুলনা ও ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর এলাকার ছুরিকাহত ১৯ বছর বয়সী সাকিবকে রেফার্ড করা হয়।
যদিও সার্জারি ও অর্থোপেডিক বিভাগে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের ডিগ্রিধারী চিকিৎসক রয়েছেন, তাদের সেবা রোগীদের ভাগ্যে জোটে না।
একজন জ্যেষ্ঠ সেবিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিয়ম অনুযায়ী ইন্টার্ন রোগী দেখে সহকারী রেজিস্ট্রারকে অবহিত করবেন এবং গুরুতর হলে বিশেষজ্ঞকে ডাকা হবে। কিন্তু এই নিয়ম মানা হয় না। সব দায়িত্ব পড়ে ইন্টার্নদের কাঁধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই অনিয়মের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি অদৃশ্য বাণিজ্যিক চক্র। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চেম্বারে সময় দেন, ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যত ইন্টার্নদের উপর নির্ভরশীল। ইন্টার্নরা রোগীর অবস্থা মোবাইলে জানালে চিকিৎসকেরা ফোনেই পরামর্শ দেন। পরে ইন্টার্নরাই রোগীর ফাইলে চিকিৎসা লেখেন এবং ‘দিনভিত্তিক সম্মানি’ও পান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ওয়ার্ডে রোগী দেখার সময় ওয়ার্ডবয়, আয়া ও ঝাড়ুদাররাই চিকিৎসাসেবার কাজ করছেন। তারা রোগীর স্বজনদের থেকে চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য শর্ট স্লিপ নিয়ে ইনজেকশন, স্যালাইন, ইউরিন ব্যাগসহ নানা জিনিস আনিয়ে নিজেরাই প্রয়োগ করেন। এতে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। গাইনি, সার্জারি ও মেডিসিন ওয়ার্ডে প্রায়ই চিকিৎসকের ভূমিকায় দেখা যায় ওয়ার্ডবয়দের।
কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, জরুরি বিভাগ থেকে রোগী আসার পর সারাদিনেও কোনো চিকিৎসক কাছে আসেন না। জরুরি মুহূর্তে সেবা দিতে চিকিৎসক পাওয়া যায় না। অনেক সময় সিনিয়র সেবিকারাও রুঢ় আচরণ করেন এবং শিক্ষানবিশ নার্সদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। সরকারি চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে দায়িত্বহীনতা এবং ফাঁকিবাজির প্রবণতা প্রকট।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াত বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সবাইকে নিয়মিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে রাতের বেলায় ওয়ার্ড রাউন্ডে চিকিৎসকেরা না এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়িত্বে অবহেলা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান।