যশোরের এড়লের বিলে জলাবদ্ধতা, তিন হাজার বিঘা জমিতে হচ্ছে না আমন চাষ
- রুহুল আমিন, যশোর জেলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০১:০২ PM , আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০১:৫৫ AM
যশোরের সর্ববৃহৎ এড়লের বিলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এখনো পানির নিচে তলিয়ে গেছে তিন হাজার বিঘা জমি। জলাবদ্ধতার কারণে আমন ধান রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কৃষকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এছাড়া অর্ধশত মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় ঘের মালিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুকভরা বাঁওড়ের স্লুইসগেট দিয়ে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি। কৃষকেরা স্লুইসগেট তুলে দিয়ে সেখানে বড় ব্রিজ নির্মাণের দাবি । পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিত আবেদনও করেছেন তারা।
জানা গেছে, চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের বিল এড়লের মৌজায় হাজার হাজার বিঘার জমিতে ধান চাষ করা হয়। পাশাপোল ও ফুলসারা ইউনিয়নের বিলের পানি সদর উপজেলার চান্দুটিয়ার বুকভরা বাঁওড়ের স্লুইসগেট দিয়ে অল্প পরিমাণে পানি নিষ্কাশন হয়। কিন্তু এ পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি বড় খাল কাটা হলেও ছোট স্লুইসগেট দিয়ে সেই পরিমাণে পানি নিষ্কাশন হচ্ছেনা। এছাড়া গেটের নিচের অংশ উঁচু ও ছোট। তাই বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বুকভরা বাঁওড়ের স্লুইসগেট ভেঙে সেখানে বড় আকারের একটি ব্রিজ তৈরি করলে কৃষকরা জলাবদ্ধতার কবল থেকে অনেকটা রেহাই পাবে। অন্যথায় বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার একর জমির ধান চাষিদের ঘরে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর সদর, ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকাজুড়ে এড়লের বিল অবস্থিত। এই তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার কৃষক বিলে সবজি ও ধানের চাষ করেন। এছাড়া শতাধিক ঘেরে মাছ চাষ করা হয়। এবারের জলাবদ্ধতায় কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানির কারণে তারা হাজার হাজার বিঘা জমিতে এখনো ধানের আবাদ করতে পারেনি। এদিকে, পাশাপোল ইউনিয়নের দশপাখিয়া গ্রামের শ’শ’ বিঘা মাছের ঘের ভেসে গেছে। এরমধ্যে রবিউল ইসলামের ৩৭ বিঘা, ফসিয়ার রহমানের ২৫ বিঘা, গোলাম রসুলের ২৫ বিঘা, মিজানুর রহমানের ১৭ বিঘা, আব্দ্রু রহিমের ১৭ বিঘা, সুমন হোসেনের ১৩ বিঘা, রাজ্জাক মোল্যার ১৩ বিঘা, সবুর খানের ৭ বিঘা, রহমত মণ্ডলের ৫ বিঘা, মোমিনুর রহমানের ৩ বিঘা, মাহবুর রহমানের ২ বিঘা, মৎস্যরাঙা গ্রামের তুহিন হোসেনের ২৫ বিঘা ও দেলোয়ার হোসেনের ১৮ বিঘা মাছের ঘের উল্লেখযোগ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে ভারি বৃষ্টির পানিতে এড়লের বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রীতিমতো পানির স্রোত চলছে। পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই এটা বিল না সাগর। পানিতে ডুবে আছে শ’শ’ কৃষকের স্বপ্ন। সদরের চুড়ামনকাটির দৌগাছিয়া, ঝাউদিয়া, দেয়াড়ার চান্দুটিয়া, গোবিন্দপুর, চৌগাছা উপজেলার পাশোপোল, ফুলসারা ও সিংহঝুলী ইউনিয়নের বিলের নিচু অংশে কৃষকরা এখনো ধান রোপন করতে পারেনি। মাঠের পর মাঠ বর্ষার পানিতে তলিয়ে আছে।
ফুলসারা গ্রামের রহমান গাজী জানান, এড়লের জলাবদ্ধতার কারণে গত বছর ইরি ও আমন ধান ঠিকমতো ঘরে ওঠানো যায়নি। এবারও নীচু জায়গার ইরি ধান পানিতে তলিয়ে ছিল। তারমধ্যে শিলা বৃষ্টিতেও ধান নষ্ট হয়েছিল। আমন মৌসুমেও কৃষকদের জমি এখনও পানির নিচে রয়েছে। অধিকাংশ বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। ধান চাষ করা ভাগ্যে জুটবে বলে মনে হয় না। জলাবদ্ধতার পানিতে ফুলসারা গ্রামের একটি অংশ মিনি কক্সবাজারে পরিণত হয়েছিল।
দশপাখিয়া গ্রামের শিক্ষক মোজাফফর রহমান জানান, তিনি ও ভাইয়েরা মিলে বিলে ২৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেন। চলতি মৌসুমে ধান চাষ করার জন্য বীজতলা জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়ে গেছে। ধান রোপণ করার সময় পার হলেও জমিতে এখনো পানি জমে আছে। এমতাবস্থায় ধান চাষ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষক আহাদ আলী জানান, ৪ বিঘা জমিতে ধান চাষ করার জন্য বীজতলা দিয়েছিলেন। পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। জমিতে এখনো পানির স্রোত চলছে। কবে পানি নেমে যাবে এটাও বলা সম্ভব না। ধান চাষ করা সম্ভব হবে না। খুব কষ্টে আছি। গতবছরও বৃষ্টির কারণে ধান চাষে লোকসান হয়েছিল। জলাবদ্ধতার কবল থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য স্থায়ী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
সিংহঝুলি গ্রামের শাহিনুর, আসাদুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন জানান, বিলের নীচু জমিতে পানি থই থই করছে। বীজতলা তলিয়ে গেছে। সময় পার হলেও ধান রোপণ করতে পারেনি। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার জলাবদ্ধতার পরিমাণ অনেকটা বেশি। কৃষকরা খুুব কষ্টে আছে। তাদের স্বপ্ন পানির নিচে তলিয়ে আছে। বুকভরা বাঁওড়ের স্লুইসগেট দিয়ে ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সহসা কাটছে না।
এ বিষয়ে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইনজামামুল রোহান জানান, এড়লের বিলের পানি বুকভরা বাঁওড়ে নেমে যাবে। আবার কৃষকদের সেচ কাজের জন্য কাটা খালে পরিমাণ মত পানি ধরে রাখার জন্য এই স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছিল। বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য বুকভরা বাঁওড়ে ৬ ভেন্টের স্লুইসগেট চালু রয়েছে। এড়লের বিলের পানি কাটাখাল দিয়ে ওই স্লুইসগেটের মাধ্যম বুকভরা বাঁওড়ে নেমে যায়। পরে ওই পানি টেনে নেয় কপোতাক্ষ নদ। তিনি আরও জানান, পানির তুলনায় বুকভরা বাঁওড় উঁচু। যে কারণে পানি এখন কম টানছে। এছাড়া বুকভরা বাঁওড়ের ডাউনে বাঁওড় কমিটি একটি স্ট্রাকচার তৈরি করেছে। ফলে পানি যাতায়াতে বাধাগ্রস্থের হচ্ছে।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি জানান, বুকভরা বাঁওড়ের স্লুইসগেট দিয়ে এড়লের বিলের অনেক বড় একটা এরিয়ার পানি নামার কারণে একটু সময় নিচ্ছে। এছাড়া কপোতাক্ষ নদে পানির চাপ রয়েছে। ফলে বাঁওড়ের পানি নদে কম নিচ্ছে। স্লুইসগেট তুলে বড় ব্রিজ নির্মাণের দাবির বিষয়ে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, কৃষকদের দাবি অযৌক্তিক বলতে পারি না। তবে স্লুইসগেট তুলে দিলে ওয়ার্টারের ওপর কোন কন্ট্রোল থাকবেনা।আগামীতে নদ বা বাঁওড় থেকে পানি বিলের ভেতর ঢুকানোর প্রয়োজন হলে তখন কি অবস্থা হবে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মোশাররফ হোসেন জানান, যশোর জেলায় ১ লাখ ৪০ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। জলাবদ্ধতার কারণে এখন পর্যন্ত ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। এড়লের বিলে এখনো ৩ হাজার বিঘা জমিতে জলাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সেখানে আমন ধানের চারা রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে পানি নামছে।