‘পাহাড় থেকে সমতলে, নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়’—বিচারের দাবিতে উত্তাল জনতা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:২৯ PM , আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০২:২৮ PM
খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় অষ্টম শ্রেণির কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে-প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা খাগড়াছড়ি। বৃহস্পতিবারের মতো আজও প্রতিবাদ–বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। আজ শুক্রবার (১৮ জুলাই) জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি করেছেন। একই দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সাত সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
আজ বেলা ১১টায় ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন ইউপিডিএফ–সমর্থিত ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নেতা-কর্মীরা। মিছিলটি মানিকছড়ি সদরের ধর্মঘর এলাকা থেকে শুরু হয়ে বটতলার নিচে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করে সংগঠনটি।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, পাহাড় থেকে সমতলে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। দেশে ধর্ষণের বিচার না হওয়ার কারণে এখন ধর্ষণের মাত্রা বেড়েছে। এ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশে বক্তব্য দেন পিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অংহ্লাচিং মারমা, জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রাঞ্জল চাকমা, মানিকছড়ি উপজেলা শাখার সদস্য আনু মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন সদস্য মনি চাকমা প্রমুখ।
রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল
খাগড়াছড়িতে কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে রাঙামাটিতেও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলার কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়াম এলাকা থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
মিছিলটি শহরের কে কে রায় সড়ক, রাজবাড়ি, শিল্পকলা একাডেমি, কালিন্দীপুর, বিজন সরণি ও নিউমার্কেট এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় জিমনেসিয়াম এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, ‘পাহাড়ের নারীরা ঘরেও নিরাপদ নয়। এই ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা কমিটির সহসভাপতি কবিতা চাকমা এই কর্মসূচির সভাপতিত্ব করেন। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ শাখার সহসাধারণ সম্পাদক মিলন চাকমার সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির শাখা সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পরিষদের শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল শাখার সভাপতি ক্যাসাইনু মারমা ও পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা প্রমুখ।
সমাবেশে তারা বলেন, ‘আমরা মনে করি নিজেদের বাড়িঘর সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পাহাড়ি নারীদের জন্য নিজেদের বাড়িঘরও নিরাপদ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চারজন ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর থেকে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই ছবিতে তাদের হাসি দেখে মনে হয় কোনো অপরাধ কিংবা অনুশোচনা লক্ষ করা যায়নি।’
রাবিতে বিক্ষোভ মিছিল
খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় আদিবাসী ত্রিপুরা কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার (১৮ জুলাই) বিকেল ৩টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্যারিস রোডে রাবি ও রুয়েটের আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দ এই বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
এসময় তারা ‘আছিয়া থেকে চিংমা খুন ধর্ষণ আর না’, ‘জুম্মু নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ কর’, ‘উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে ভূমি দখল বন্ধ চাই’. ‘অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কর’ ‘আদিবাসী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত কর’, ‘নারীর ওপর নিপীড়ন বন্ধ কর’ ‘রাষ্ট্রীয় হেফাজত বন্ধ কর’-সহ বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন হাতে প্রতিবাদ জানায়।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিচারের দাবি জানিয়ে শ্যামল জুম্মু বলেন, আমরা এই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা এর আগেও বারবার দেখেছি পাহাড়িদের ধর্ষণ ও হামলা হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি না। এমনকি হামলার প্রতিবাদ করতে গেলেও আমরা আবার হামলার শিকার হই। আমরাও তো স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছিলাম, তারপরও আমাদের সাথে এত বৈষম্য কেন? আমরা চিংমার ধর্ষণ ও খুনসহ সকল ঘটনার প্রতিবাদ জানাই।
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী রিছার্চ চাকমা বলেন, আমরা প্রতিবাদ করতে গেলেই আমাদের উপর হামলা চালানো হয়। আমরা যদি রুখে দাঁড়াই, পার্বত্য চট্টগ্রাম অচল হয়ে যাবে। গত তিন মাস আগেও আমরা এক ধর্ষণের বিচারের দাবিতে প্যারিস রোডে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিচার পাইনি। আমরা এদেশে মিয়ানমার বা চীন থেকে উড়ে আসিনি। আমরা সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করি। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি প্রশাসন ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেয়।
বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন
ধর্ষণের ঘটনার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর সাত সংগঠন। আজ দুপুরে খাগড়াছড়ির বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের হলরুমে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। সংগঠনগুলো হলো বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব কল্যাণ সংসদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম, বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব সংসদ ও বাংলাদেশ ত্রিপুরা শ্রমিক সংসদ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নেতারা বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার জন্য একটি দলের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; কারণ, মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমরা কোনো মহলের প্ররোচনা বা উসকানিতে পা না দেওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কমল বিকাশ ত্রিপুরা, ত্রিপুরা ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ক্ষনি রঞ্জন ত্রিপুরা, ত্রিপুরা যুব কল্যাণ সংসদের আহ্বায়ক ভিক্টর ত্রিপুরা, ত্রিপুরা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিপিন ত্রিপুরা, ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরামের খঞ্জন জ্যোতি ত্রিপুরা, ত্রিপুরা যুব সংসদের সভাপতি রূপক ত্রিপুরা, ত্রিপুরা শ্রমিক সংসদের প্রতিষ্ঠাতা পরেশ ত্রিপুরা প্রমুখ।
গত বুধবার রাতে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে অভিযোগে খাগড়াছড়িতে মামলা হয়। এ ঘটনায় ওই দিনই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরমান হোসেন (৩২), সদস্য ইমন হোসেন (২৫) ও এনায়েত হোসেন (৩৫) এবং শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (৩২)। মামলার অন্য দুই আসামি হলেন ভাইবোনছড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুনির ইসলাম (২৯) ও ছাত্রদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল ইসলাম (২৩)। তারা পলাতক আছেন।
বর্তমানে কিশোরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবার দুপুরে কিশোরীর বড় বোন মুঠোফোনে বলেন, তার ছোট বোনের অবস্থা গুরুতর। কিছু খেতে পারছে না। লোকজন দেখলে ভয় আর লজ্জায় কেঁপে উঠছে।