বুক রিভিউ
‘অরিজিন’ এক সম্ভাবনার গল্প
- আনিকা তাসনিম সুপ্তি
- প্রকাশ: ১৭ মে ২০২০, ০৫:৪৬ PM , আপডেট: ১৭ মে ২০২০, ০৫:৪৬ PM
‘বিজ্ঞান আর ধর্ম কিন্তু প্রতিপক্ষ নয়। দুটো আলাদা আলাদা ভাষায় একই গল্প বলার চেষ্টা করে বলতে পারো। পৃথিবী এ দুটোকে ধারণ করার মত যথেষ্ট বড়!’- বেস্টসেলার লেখক ড্যান ব্রাউনের ‘অরিজিন’ উপন্যাসে রবার্ট ল্যাংডনের করা ভালোলাগার মতো একটি উক্তি এটি। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যেকার চিরন্তন দ্বন্দ্ব, সংকেত, গুপ্ত সংঘ, তথ্যবহুল ইতিহাস আর অনাকাঙ্ক্ষিত সব রহস্যকে উপজীব্য করে উপন্যাস লিখেন ড্যান ব্রাউন।
১৯৯৮ সালে ড্যান ব্রাউনের প্রথম উপন্যাস ডিজিটাল ফোরট্রেস (Digital Fortress) প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি পাঠক মহলে তেমন সাড়া ফেলতে পারে না। পরবর্তীতে ২০০০ সালে তিনি প্রকাশ করেন এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস (Angels & Demons)। এই বইয়ের মাঝে তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র রবার্ট ল্যাংডনকে। যদিও তখন বইটি বেশি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি কিন্তু ২০০৩ সালে দ্য দা ভিঞ্চি কোড (The Da Vinci Code) লিখে তিনি রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
বইটি হয় বেস্টসেলার এবং নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার লিস্টে চলে আসে। তখন ২০০০ সালে প্রকাশ পাওয়া এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস (Angels & Demons) বইটিও নতুন করে আলোচনায় আসে। এরপর তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্র রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের আরো জনপ্রিয় কিছু বই বের করেন- ২০০৩ এ ইনফার্নো (Inferno), ২০০৯ এ দ্য লস্ট সিম্বল (The Lost Symbol) এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত অরিজিন (Origin)। উল্লেখ্য তার তিনটি বই দ্য দা ভিঞ্চি কোড, ইনফার্নো এবং এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস নিয়ে উপন্যাসের নামে তিনটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়েছে।
‘অরিজিন’ ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের পঞ্চম এবং এখন পর্যন্ত শেষ বই। উপন্যাসের আপাত প্রধান চরিত্র এডমন্ড কিয়ার্শ একজন নাস্তিক ফিউচারিস্ট এবং প্রযুক্তিবিদ যিনি রবার্ট ল্যাংডনের ছাত্র এবং বন্ধু। শিল্প ও সংকেতের প্রতি তার আছে গভীর অনুরাগ। গণিতের গেম থিওরি তার কাজের ক্ষেত্র। এর মাধ্যমে কিয়ার্শ যে কয়টি ভবিষ্যৎবাণী প্রকাশ করেছেন তার সবকয়টিই মিলে গিয়েছে। এবার কিয়ার্শ আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে বেশি খোঁজা দুটি প্রশ্নের উত্তর যা প্রকাশের আগেই বিশাল এক বিতর্কের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তার মতে এই আবিষ্কার নাকি পৃথিবী থেকে মুছে দেবে ধর্মের অস্তিত্ব!
এই ঘোষণা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় স্পেনের গুগেনহাইম জাদূঘরে যেখানে উপস্থিত হলেন প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন। তবে অনুষ্ঠান শুরু হলেও ঘোষণা পর্যন্ত আসার আগেই অদৃশ্য একটি পক্ষের হস্তক্ষেপে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত একটি ব্যাপার ঘটে যায় যেখান থেকেই মূলত কাহিনী শুরু।
ঘটনাচক্রে রবার্ট ল্যাংডন জাদূঘরের ডিরেক্টর এ্যাম্ব্রা ভিদালকে নিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। শুরু হয় স্পেন শহরের অলিতে-গলিতে অভিযান। গন্তব্য একটি পাসওয়ার্ড! এই পাসওয়ার্ডের সংকেত রয়েছে ইতিহাস, আধুনিক শিল্পকলা ও প্রযুক্তির এক গোলকধাঁধায়। ল্যাংডন ও জাদুঘরের ডিরেক্টর ছুটলেন পাসওয়ার্ডের পিছনে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো কিয়ার্শের তৈরী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুপার কম্পিউটার ‘উইনস্টন’।
কিন্তু অদৃশ্য প্রতিপক্ষ তাদের কাজেও ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে। কাহিনীর নাটকীয়তা থেকে বারবার ইঙ্গিত পাওয়া যায় একটি ভীষণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষের এতটাই শক্তিশালী যে স্পেনের রাজপরিবার পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এই অদৃশ্য শত্রু চার্চের সাথে সম্পর্কিত। তার সাথে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, শাসনব্যবস্থায় চার্চের হস্তক্ষেপ এবং রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ।
এর ফাঁকেই লেখক এক গুপ্ত সংগঠন হিসেবে পালমেরিয়ান চার্চের ইতিহাস এনে হাজির করেন কিন্তু উপন্যাসে তা খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে নি। এর মধ্যেই ল্যাংডন তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির জোরে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।
আস্তে আস্তে পাঠকের সামনে তৃতীয় আরেকটি সবজান্তা পক্ষ উঁকি দিতে থাকবে কিন্তু লেখকের শক্ত লেখনীর কৌশলে অধিকাংশ পাঠকই তৃতীয় আরেকটি পক্ষ যে আছে সে সম্পর্কে মাথা ঘামাতে গিয়েও ঘামাবে না।
সব শেষে পাঠক পাবেন সেই দুইটি প্রশ্নের উত্তর। খুব চেনা দুইটি প্রশ্ন এবং উত্তরও খুব পরিচিত এবং বিতর্কিত। শুধুমাত্র উপস্থাপনার গুণেই লেখক মাত্রাতিরিক্ত বর্ণনামূলক দৃশ্যের পরেও পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত। কাহিনীর শুরু থেকে কিয়ার্শের আবিষ্কারের প্রতি যেরকম আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত বলতেই হয় তেমন আহামরি কিছুই ছিল না।
বইটি যদিও অত্যন্ত তথ্যবহুল ছিল কিন্তু সত্যি বলতে কিছু জায়গার বর্ণনা বড্ড বেশি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কিছু জায়গায় প্রযুক্তির অতি উচ্চ ব্যবহার ও বর্ণনায় পাঠকের একঘেয়েমী ধরে যেতে পারে। ল্যাংডন সিরিজের প্রথম বইতে পাঠক যেরকম সমৃদ্ধ সিম্বলের খেলায় মেতে উঠে এখানে তার কিঞ্চিৎ স্বাদ পাওয়া যায় মাত্র। কিছু জায়গা অতি কাকতালীয় মনে হয়েছে। তাছাড়া মূল বিষয়বস্তুর সাথে অন্যান্য বিষয়ের যোগসূত্রের রশিটা দূর্বলই ছিল।
তবে ব্রাউন এখানে তাঁর নিজস্ব স্টাইলে যেভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, সেটা পছন্দ হয়েছে। ধর্ম আর বিজ্ঞানের চিরায়ত সংঘাত নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
আমার মতে শুধু বিষয়বস্তু সম্পর্কে হালকা ধারণা নিয়েই বইটি পড়া থেকে বিরত থাকা বোকামী। বইটি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী দুই শ্রেণীর মানুষেরই পড়া উচিৎ। নাস্তিকরা সাধারণত ধার্মিকদের মনমানসিকতা সম্পর্কে পুরোপুরি তাচ্ছিল্যপূর্ণ। আবার অতি গোড়া ধার্মিকরাও কিছু কিছু সময় ধর্মতত্ত্বের মূল বিষয়কে ছাড়িয়ে নাস্তিকদের কার্যকলাপে আঘাত হানতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখান থেকেই মূলত সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ড্যান ব্রাউন ব্যক্তিগতভাবে যেই ভাবাদর্শীই হোক না কেনো 'অরিজিন' এ তিনি কিছু কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে নাস্তিকতা এবং ধর্মতত্ত্বের সংঘাতের মূল জায়গা চিহ্নিত করেছেন এবং অকপটে বাস্তব কিছু সত্যকে তুলে এনেছেন যেখানে নিরপেক্ষতা বিরাজমান ছিল৷ ড্যান ব্রাউন স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সত্যিই আমরা কতটুকু ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি নিকট ভবিষ্যতে!
‘অরিজিন’ উপন্যাসে অতীত আর ভবিষ্যৎ মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। অতীতের বিভিন্ন ঘটনার সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রূপই ধরা পড়ে ‘অরিজিন’ উপন্যাসে। এটা গল্প হলেও প্রসঙ্গগুলো ভীষণ বাস্তব। এডমন্ড কিয়ার্শের আবিষ্কার যতটা না নতুনত্বের আলোড়ন সৃষ্টি করে তার চেয়ে বেশি এটা পাঠকের চিন্তায় নাড়া দিয়ে যায়, নতুন ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।