বুক রিভিউ
আরিফ আজাদের ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’
- মোস্তাফিজুর রহমান
- প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২০, ০৪:৩৫ PM , আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২০, ০৪:৩৫ PM
বুক রিভিউ সবসময় যে ভাল দিকটাই লিখতে হয় এমনটা আমার কাছ মনে করা পক্ষপাতদুষ্ট হয়। প্যারাডক্সিকেল নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা বই। শুরুতেই বইটির কিছু বিষয়ে আবেগ বিবর্জিত করে রিভিউ দেয়ার চেষ্টা করি। কয়েকটা চ্যাপ্টার ভালো। বিশেষত যেসব চ্যাপ্টারে বিজ্ঞান নেই, শুধু দর্শন আছে, সেগুলো ভালো। সবচেয়ে ভালো সেসব চ্যাপ্টার, যেগুলোতে কুরআনের মুজেজা বা কুরআন সম্পর্কে নাস্তিকদের সিলি প্রশ্নের জবাব তুলে ধরা হয়েছে। যেমন জুলকারনাইনের পঙ্কিল জলাশয়ে সূর্যাস্ত, নারী মৌমাছি, মুসা (আ.) বনাম ইউসুফ (আ.) এর বাদশাহ্’র টাইটেল এগুলো।
এগুলো অবশ্য জানা বিষয়। আরিফ আজাদ নিজে আবিষ্কার করেননি, সেটা তিনি দাবিও করেননি। কোনো টপিক্সের উপর বিভিন্ন স্থানে থাকা তথ্য নিজের ভাষায় লিখে, একত্রিত করে বই প্রকাশ করাটাও কৃতিত্বের কাজ।
একটা সময় পঙ্কিল জলাশয়ের মতো সিম্পল প্রসঙ্গ তুলেই নাস্তিকরা কুরআন নিয়ে হাসাহাসি করছে। আর আস্তিকরা এই সিম্পল জিনিসের জবাব দিতে না পেরে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে। এই বইয়ের কারণে কিছু মানুষ যদি গালাগালি ছেড়ে যুক্তির পথে আসে, সেটাও লেখকের বিশাল একটা অর্জন হবে।
কয়েকটা চ্যাপ্টারের যুক্তিগুলো খুবই দুর্বল, হাস্যকর এবং কুযুক্তি। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিষয়ক চ্যাপ্টারগুলো। কিছু কিছু উপমাও হাস্যকর এবং অপ্রয়োজনীয়। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, সেসব আলোচনার মধ্যেও অবশ্য বাড়াবাড়ি আছে। চর্বিত চর্বনে আগ্রহী না। রেফারেন্স, ‘পিয়ার রিভিউড জার্নাল’ টাইপ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, কিছু কিছু অধ্যায়ে যে পদ্ধতিতে যুক্তি হাজির করা হয়েছে, সময়ের সাথে সাথে এই নিয়ে হাস্যরস আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আরিফ আজাদের বইয়ের নাস্তিকরা একইসাথে তিন গোয়েন্দার ফগর্যাম্পারকটের মতো গর্দভ এবং বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো শয়তান। তারা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে, সাজিদকে অপমান করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে মরিয়া হয়ে থাকে, কিন্তু সাজিদের কথার পিঠে একটা কথাও বলতে পারে না। নিজের বক্তব্য শেষ করার পর সাজিদের ম্যারাথন লেকচারের সাথে হ্যাঁ-হু করতে থাকে। সাজিদ যে তাদেরকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতেই পারে না। বাস্তবতা এরকম না। বাস্তবের নাস্তিকরা শয়তান হলে এতো সহজে ছেড়ে দেয় না। বাস্তবে কথার পিঠে কথা আরও ইন্টারেস্টিং হয়। বইয়ের বর্ণনার এই ভঙ্গি খুবই দুর্বল, বিরক্তিকর এবং পক্ষপাতদুষ্ট।
একটা চ্যাপ্টারে নাস্তিক রবিজিৎ রায়ের একটা উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে সরাসরি অভিজিৎ রায় ব্যবহার করা হলেও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেটা সমস্যা সেটা হচ্ছে, একটা চ্যাপ্টারে হুমায়ূন রুবায়েত আজাদ নামের এক শিক্ষকের মাধ্যমে মূলত অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদকে অপমান করা হয়েছে। এই ধরনের প্রচেষ্টা একজন জনপ্রিয় থ্রিলার লেখকের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় একটা ব্যাপার।
বাংলাদেশে নামের অভাব নাই। কারও সমালোচনা করতে হলে সরাসরি করাই ভালো। কাছাকাছি নাম নিয়ে বিকৃত একটি চরিত্রে কাউকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা খুবই নিম্ন মানসিকতার পরিচায়ক। বইটা বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ফেসবুকের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দেশের অধিকাংশ মানুষেরই লজিকালি চিন্তা করার ক্ষমতা খুবই নিম্নমানের। তারা আপাতত এই বইটি পেয়েছে, তাই এটাকেই লুফে নিয়েছে। ভবিষ্যতে যখন এই টপিকে আরও ভালো কোনো বই আসবে, তখন তারা সেটাকেই গ্রহণ করবে এবং এই বইয়ের ত্রুটিগুলো খুঁজে পাবে।
আরিফ আজাদ শুরু করেছেন, বাকিরা সেটা এগিয়ে নিবে। এই বই নিয়ে ‘মুক্তমনা’ সমাজের ক্ষোভ, সমালোচনা, গালাগালি শুধু হাস্যকরই না, রীতিমতো উদ্বেগজনক। বইটি পরিষ্কারভাবেই উচ্চশিক্ষিতদের জন্য লেখা হয়নি, লেখা হয়েছে এই বিষয়ে নতুনদের জন্য। সুতরাং এর সীমাবদ্ধতা থাকবেই।
রিভিউ দেওয়ার মতো করে পোস্ট আকারে সেই ভুলত্রুটিগুলো নির্দেশ করে দেওয়াই যথেষ্ট। বইটি স্ক্যান করে সেটা অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া, এর প্যারডি লিখে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা শুধু অন্যায়ই না, অপরাধও। বইটির বিপুল জনপ্রিয়তা আমাদের সমাজের জন্য হতাশার বা ভয়ের কিছু না, বরং আশাব্যঞ্জক। আগে আবেগী আস্তিকরা নাস্তিকদের যুক্তির সাথে না পেরে গালাগালি করত। এই বইয়ের জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, যথাযথ যুক্তি পেলে তারা গালাগালি বাদ দিয়ে তর্ক-বিতর্কে অংশ নিতেও আগ্রহী। এরকম সময়ে বইটির শুধুমাত্র সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে এর বিরোধিতা, লেখকের কুৎসা রটনা শুরু করলে এই সুন্দর সম্ভাবনাটা বিনষ্ট হবে।
আমরা স্কুলের ইতিহাসের বইয়েও অনেক মিথ্যা তথ্য শিখি। এরপর আগ্রহ থাকলে বড় হয়ে নিজে নিজে প্রকৃত ইতিহাস শিখতে পারি। বিজ্ঞান সম্পর্কেও একই কথা। ছোটকালে শেখা জ্ঞান সময়ের সাথে সাথে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করতে থাকে। প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ যারা পড়েছে, আশা করি তারাও ধীরে ধীরে এই জাতীয় অন্যান্য বই পড়বে এবং তাদের চিন্তাভাবনার প্যাটার্ন সমৃদ্ধ হবে।
প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ২ বের হয়েছে। তিন, চারও বের হোক, সমস্যা দেখি না। লিখতে লিখতে লেখকের যুক্তি প্রদানের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাক, আর যুক্তিগুলো অ্যাকাডেমিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। নাস্তিকদেরকে বাংলা সিনেমার মতো ভিলিফাই করা বা হুমায়ূন আজাদের মতো কাউকে নেগেটিভলি উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা না হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়