ঢাবি চারুকলার ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন কাবেরী আজাদ, জেনে নিন তার সাফল্যের গল্প

কাবেরী আজাদ
কাবেরী আজাদ  © লেখকের সৌজন্যে

[উচ্চমাধ্যমিকের পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হতে চান অনেকেই। এ অনুষদে জায়গা পাওয়ার জন্য তারা যেমন কঠোর পরিশ্রম করেন, তেমনই অধ্যবসায় আর শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে রীতিমতো লড়াই করেন। তাদের জন্য নিজের প্রস্তুতি, অভিজ্ঞা ও সাফল্যের গল্প লিখেছেন ঢাবি চারুকলা অনুষদের (২০২০–২১ সেশনে) ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম কাবেরী আজাদ। তার প্রস্তুতির পথচলা ছিল নিয়মিত অনুশীলন, ধৈর্য, মানসিক দৃঢ়তা এবং শেখার আগ্রহে ভরপুর। আঁকার প্রতি তার ভালোবাসা তাকে শুধু পরীক্ষায় সেরা হতে সাহায্য করেনি, বরং শিল্পকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও করেছে আরও বিস্তৃত ও সংবেদনশীল। কাবেরীর লেখা শিল্পচর্চায় আগ্রহী অসংখ্য তরুণ–তরুণীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ (Drawing & Painting) বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর কিছু বিষয় নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি। এখানে এসে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় পথচলায়। কয়েক বছরে যেসব সমবয়সী কিংবা অনুজদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের চারুকলায় আসার গল্পগুলো সত্যিই বিচিত্র ও অনুপ্রেরণাদায়ক। কেউ বহু বছর ধরে শিল্পচর্চায় নিবিষ্ট, কেউ বা ছাত্রাবস্থাতেই দক্ষ শিল্পী বা ডিজাইনার হিসেবে নানা পেশাগত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আবার এমন অনেকে আছেন, যারা বিভাগে ভর্তি হওয়ার আগে আঁকার জন্য পেন্সিলটিও হাতে তোলেননি। ভিন্নধর্মী যাত্রাপথগুলোই আমাকে বুঝিয়েছে, শিল্পের দুনিয়ায় শুরুটা কোন জায়গা থেকে হলো, তা কখনোই মূল বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো শিল্পের প্রতি একাগ্রতা, চর্চা এবং নিজেকে প্রকাশ করার আকাঙ্ক্ষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বিভাগ আছে ৮টি। অঙ্কন ও চিত্রায়ণ (Drawing & Painting), প্রাচ্যকলা (Oriental Art), গ্রাফিক ডিজাইন, ভাস্কর্য (Sculpture), ছাপচিত্র (Printmaking), কারুশিল্প (Crafts), মৃৎশিল্প (Ceramics) এবং শিল্পকলার ইতিহাস (History of Art)। এ বিষয়গুলোর যেকোনো একটি নিয়ে ঢাবিতে পড়াশোনা করতে হলে ‘চ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ঢাবি ছাড়াও দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও চারুকলা অনুষদ আছে। সেখানে বিষয়বৈচিত্র্য তুলনায় কিছুটা কম বটে। শিল্পশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য এদেশে এগুলোই মূলত অপশন বলা যায়।

ঢাবির চারুকলা প্রাঙ্গণে ছবি আঁকছেন কাবেরী আজাদ। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চ’ ইউনিটে ২০২০–২১ সেশনে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি যখন শুরু করি, ধারণাও করিনি যে পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর প্রথম হব। উচ্চমাধ্যমিক জীবনের মাঝামাঝি আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে এইচএসসির পর চারুকলা অনুষদে পড়াশোনা করব। বড় শিল্পী হব বা এ ধরনের কোনো মোটিভেশন থেকে আমি চারুকলায় পড়তে চাইনি। চেয়েছিলাম নিছকই ছবি আঁকতে কয়েকটা বছর। ছোটবেলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিল্পশিক্ষা না থাকলেও ছবি আঁকার চর্চা ছিল।

আমি পড়াশোনা করেছি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় আর্ট ক্লাবের জন্য এবং নানা অনুষ্ঠানে প্রচুর ছবি আঁকতে হতো। ক্লাস ইলেভেনে থাকা অবস্থায় মনে হলো, আমি শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি জানতে চাই। কোথায় যেন একটা ঘাটতি আছে আমার, শেখার আছে অনেক কিছু, হয়েতা এমনটা মনে হয়েছিল। অন্য কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করেও নিজের উদ্যোগে সেসব হয়তো জানা যেত; কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম টানা কিছু বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ছবি আঁকতেই। খানিকটা যেন নিজেকে প্রতিদিন ছবি আঁকতে বাধ্য করতে চাওয়ার মতোই ছিল ব্যাপারটা। এ কারণেই চারুকলা অনুষদে পড়তে আসা।

ক্যাডেট কলেজে পড়ার পর সামাজিক জায়গাগুলো থেকে এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে যে একজন প্রাক্তন ক্যাডেট হয়তো সামরিক পেশা অথবা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ‘ভালো সাবজেক্টে’ পড়াশোনা করবে। তার উপর চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাজে নানা রকম জাজমেন্ট তো আছেই। কিন্তু এসবকে আমি কখনোই পাত্তা দিইনি। ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে আমি যে প্রাণশক্তি অনুভব করেছি, নিজেকে যেভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখেছি, সেটাকেই গুরুত্ব দিয়েছি। আমি ঢাবি আর জাবির চারুকলা অনুষদ ছাড়া আর কোনো জায়গার ভর্তি পরীক্ষার ফর্মই তুলিনি। অর্থাৎ নিজের জন্য আর কোনো অপশন যেন না থাকে, নিজেই সেই ব্যবস্থা করে রাখা আর কি।

ভর্তি প্রস্তুতির সময় শুরুতে তো কোনো দিশা পাচ্ছিলাম না। পারিবারিকভাবে কারও যেমন শিল্পশিক্ষার সঙ্গে পরিচয় থাকে, আমার তেমন কিছুই ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত চারুশিল্প সম্পর্কে জানার মতো সাবজেক্ট থাকে না আমাদের সাধারণ প্রতিষ্ঠানে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ‘চ’ ইউনিট প্রস্তুতির সময় এটা ফেস করেন তা আমি দেখেছি। পরিচিত কোনো কোচিং সেন্টারও নেই চারুকলা ভর্তি প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। ২০২০ সালের প্যান্ডেমিকের সময় আমি ঘরে বসে একাডেমিক আর্টের নানা টিউটোরিয়াল দেখার চেষ্টা করতাম ইউটিউবে। একটু একটু করে শিখছিলাম নিজের মতো। পরে একজন বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি, প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা ভর্তিচ্ছুদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করেন।

ঢাবির চারুকলা অনুষদের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাবেরী আজাদ। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমি ঢাবির শিক্ষার্থীদের সেই কর্মশালায় ভর্তি হয়ে যাই। পরীক্ষার ঠিক আগে প্রতি বছর কর্মশালাগুলো থেকে বিস্তারিত নির্দেশিকাসহ গাইডবুকও প্রকাশিত হয়। কর্মশালাগুলোর অনলাইন পেজ থেকে বই সংগ্রহ করাও সহায়ক হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে, কর্মশালায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি ইন্টারনেট থেকে কীভাবে আমার আঁকা উন্নত করা যায় সে বিষয়ে প্রচুর ব্যক্তিগত গবেষণা আমাকে সাহায্য করেছিল। তবে কর্মশালাগুলো বেশিরভাগ ঢাকাকেন্দ্রিক বা নির্দিষ্ট শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী খোঁজ পেলেও ভর্তি হতে পারেন না নানা কারণে। তাদের জন্য বলব, ব্যক্তিগতভাবে যদি কোনো মেন্টর পাওয়া যায়, সেটাও খুব কাজে দেয়। কারণ কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া চারুকলা ভর্তিতে ভালো করা সত্যিই কঠিন। আর ভর্তি পরীক্ষার চাপের মধ্যে যেহেতু সময় খুব সীমিত থাকে, তাই দিকনির্দেশনা পাওয়া সময় ব্যবস্থাপনাতেও সাহায্য করে।

পরীক্ষার নিয়মনীতি প্রতি বছর পরিবর্তিত হতে পারে, তাই আবেদনকারীদের অবশ্যই আপডেটেড থাকতে হবে। সাধারণত পরীক্ষায় দুই ধরনের মূল্যায়ন থাকে, মাল্টিপল চয়েস (MCQ) ও অঙ্কন পরীক্ষা। MCQ এবং অঙ্কন পরীক্ষার নম্বর বণ্টন সাধারণত ৪০–৬০ বা ৫০–৭০ এর মধ্যে থাকে। অর্থাৎ উভয় অংশই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

MCQ অংশের জন্য আমার মতে NCTB-র পাঠ্যবইগুলো অনুসরণ করা সবচেয়ে ভালো কৌশল, বিশেষত বাংলা, ইংরেজি ও সাহিত্যের অংশে। কোচিং সেন্টারগুলো প্রায়ই এই বইগুলো এড়িয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাঠ্যবই সাধারণ জ্ঞান অংশেও সাহায্য করতে পারে। এর সঙ্গে শিল্পকলার ইতিহাস, শিল্প উপকরণ, লোকসাহিত্য, লোকশিল্প ও জাতীয়–আন্তর্জাতিক শিল্পীদের জীবনীভিত্তিক প্রশ্ন থাকে। বিগত বছরের প্রশ্ন সমাধান করলে এগুলো স্পষ্ট ধারণা দেয়।

ব্যবহারিক বা অঙ্কন পরীক্ষাকে সহজ ভাবা ভুল হবে। এখানে নম্বর বেশি থাকে, এবং অ্যাকাডেমিক ড্রয়িংয়ের কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা থাকা জরুরি। অবশ্য ভর্তি পরীক্ষায় মাস্টার শিল্পীর মতো আঁকা প্রত্যাশা করা হয় না। তবে পেন্সিল লাইনের নিয়ন্ত্রণ, অনুপাতের বোধ, আলো–ছায়া, কম্পোজিশন ও ত্রি-মাত্রিক উপলব্ধি, এসবের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের লাইভ ড্রয়িং বা সামনাসামনি দেখে আঁকা খুব জটিল, বিশেষত নতুনদের জন্য। অনেকেরই রঙ দিয়ে আঁকার অভিজ্ঞতা থাকতে পারে; কিন্তু শুধুই রেখা দিয়ে এসব গুণ প্রকাশ করা কঠিন পরিশ্রমের বিষয়।

প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মানসিক প্রস্তুতি। পরীক্ষার আগে নার্ভাস হওয়া কোনো কাজে আসে না। সহজ থেকে কঠিনের দিকে যাওয়া আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। আর পরীক্ষার আগে অতিরিক্ত মুখস্থ করার চেষ্টা করলে ক্লান্তি আর বিভ্রান্তিই বাড়ে। অনেকে কঠিন বিষয় ভালোভাবে পড়ে আসেন, কিন্তু খুব সহজ প্রশ্নে আতঙ্কের কারণে ভুল করেন।

সবশেষে বলব, পরীক্ষার আগে সুস্থ থাকা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং যথেষ্ট পানি পান করা জরুরি। কোনো পরীক্ষাই স্বাস্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর ভর্তি পরীক্ষা জীবনের শেষ কথা নয় ‘চ’ ইউনিটের ক্ষেত্রে তো আরো নয়। এই ইউনিটে ভর্তি হতে পারা না-পারা কারও শিল্পী হওয়া নির্ধারণ করে না। তবে প্রতিষ্ঠান অনেক সুযোগ সুবিধা দেয় এটা সত্যি। তাই সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা করে। আমার জন্য যেসব পদ্ধতি কাজ করেছিল, সেগুলোই শেয়ার করলাম, সবাই নিশ্চয়ই একইরকম নাও হতে পারে। বিশ্বাস করি প্রতিটি শিক্ষার্থীর যাত্রা আলাদা। শক্তি, দুর্বলতা, চাহিদা—সবই ভিন্ন। আমরা যা করতে পারি, তা হলো নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। 

চারুকলা অনুষদে ভর্তির যাত্রা যেমন সৃজনশীল, তেমনই চ্যালেঞ্জপূর্ণ। আমার প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা থেকে বলব, এ পথ কঠিন হলেও নিষ্ঠা, নিয়মিত অনুশীলন এবং নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে সফলতা দূরে থাকে না। শিল্পচর্চার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসাই এখানে সবচেয়ে বড় শক্তি। যারা চারুকলায় স্বপ্ন বুনছেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অগ্রজ হিসেবে বলব, আপনার একাগ্রতা ও পরিশ্রমেই খুলে যাবে সৃজনশীলতার নতুন দরজা। শিল্পশিক্ষায় আগ্রহী সব শিক্ষার্থীর জন্য আমার শুভকামনা রইল।

কাবেরী আজাদ : চিত্রশিল্পী ও শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ