বুয়েট ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে ফারাবি
আমার পড়ার রুটিন ছিল সকাল ৯টা থেকে রাত ৩টা, মাঝে নিত্যকর্মের বিরতি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৫৫ PM , আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৫৬ PM
শাহরিম আল ফারাবি। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ৬২তম স্থান করেন তিনি। পাশাপাশি প্রকৌশল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় তার অবস্থান ৪৬তম। ভর্তি পরীক্ষায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুয়েটে ভর্তিচ্ছু অনুজদের জন্য দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। কোন কৌশলে পড়াশোনা করেছেন, কীভাবে সময় ব্যবস্থাপনা ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং সাফল্যের পেছনের গল্প— সবই তিনি তুলে ধরেছেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে।
ফারাবির বাড়ি ঢাকা দোহারে। তার বাবা আব্দুল করিম জিয়ন। তিনি পেশায় একজন সরকারি কর্মকর্তা। তার মা শাহনাজ করিম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ফারাবি দুই ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার বড় বোনও বুয়েট শিক্ষার্থী। ফারাবি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন।
পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসও করেছে ফারাবি। ছিলেন নটর ডেম আবৃত্তি দলের সভাপতি। ২০২২ সালের বাংলাদেশ বায়োলজি অলিম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। এছাড়াও নিয়মিতভাবে গণিত, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতেন। পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পদক।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বেশ কৌশলী ছিলেন ফারাবি। তার মতে, এখানে মেধার চেয়ে পরিশ্রমটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে বিবিধ কারণে আমার পড়াশোনায় খানিক ছেদ পড়েছে। তবে ডিসেম্বর থেকে আমি আবার নবোদ্যমে পড়ালেখা শুরু করি।
তিনি বলেন, আমি অনুধাবন করলাম, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে মেধা নয়, পরিশ্রমটাই বেশি জরুরি। যত বেশি প্র্যাকটিস করা যাবে, তত বেশি দুর্বলতা কাটবে। যেহেতু আমার পড়াশোনায় ছেদ পড়েছিল, সেই ঘাটতি পূরণ করতে আমাকে কিছুটা বাড়তি পড়াশোনা করতে হয়েছে— সকাল ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত। কোনো কোনোদিন ঘুমের সময় আরও কমে যেতো। এভাবে ২-৩ মাস পেরিয়ে অ্যাডমিশন টেস্টের আগে ট্র্যাকে আসতে পেরেছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, প্রকৌশল গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা ছিলো ৩ মার্চ। পরীক্ষার স্ট্র্যাটেজি হিসেবে আগের ২ দিন পড়ালেখায় সময় কম দিয়ে মানসিক চাপমুক্ত ছিলাম। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার আগেও আমি এভাবে ২ দিন চাপমুক্ত থাকার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলাম। প্রকৌশল গুচ্ছ পরীক্ষার ছয় দিনের মাথায় ৯ মার্চ ছিল বুয়েট রিটেন এক্সাম। ওইদিন ভোরবেলা প্রকৌশল গুচ্ছের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। সকালে ঘুম ভাঙে বাবার ‘সিকেরুয়েটে ৪৬তম হয়েছো’ কথাটি শুনে। আমি বেশ উদ্দীপিত হয়েই বুয়েট এক্সামের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। সিকেরুয়েট ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট আমাকে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার জন্য সাহস জুগিয়েছে।
ভর্তি পরীক্ষায় নিজের প্রস্তুতির বিষয়ে ফারাবি বলেন, অ্যাডমিশন ফেইজের শুরু থেকেই আমি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ এই তিন বিষয়ে সমান গুরুত্বারোপ করি। প্রতিটি অধ্যায় এক বার করে রিভিশন দেওয়ার পর ওই অধ্যায় সংশ্লিষ্ট মূল বইয়ের অনুশীলনী ও সহায়ক বইয়ের প্রবলেমসমূহ সলভ করে অনুশীলন করতাম। অ্যাডমিশন টেস্টে ভালো করতে মেধা নয়, পরিশ্রমটাই বেশি জরুরি। যত বেশি প্র্যাকটিস করা হবে, তত বেশি নির্ভুলতা বাড়বে। সহজ ম্যাথও স্কিপ না করে আয়ত্তে রাখতাম।
তিনি বলেন, আমার পড়াশোনার সময়সূচি ছিল— সকাল ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত। মাঝে নিত্যকর্মের বিরতি ছিল অবশ্য। তন্দ্রা কাটাতে নিয়মিত কফি খেতাম। পরীক্ষার আগে মানসিক চাপমুক্ত থাকাটা খুব জরুরি। এজন্য এক্সামের আগের দু’দিন কিছুটা কম পড়েছিলাম।
অনুজদের পরামর্শ দিয়ে ফারাবি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত কোনো টপিক স্কিপ না করে বোর্ড এক্সামের জোরালো প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এইচএসসি পরীক্ষার আগে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ডেডিকেটেড কোনো প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন নেই। ভর্তি পরীক্ষায় অর্ধেকাংশই আসবে বোর্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন। বাকি অর্ধেক প্রস্তুতি নিতে হবে এইচএসসি পরীক্ষার পর।
তিনি বলেন, একেক শিক্ষার্থীর দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে গোল্ডেন আওয়ার থাকে, যে সময়ের মধ্যে ব্রেন খুব ভালোমতো ইনপুট নিতে পারে। শিক্ষার্থীকে নিজে অ্যানালাইসিস করে গোল্ডেন আওয়ার নির্ধারণ করে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাকাডেমিক ফেইজের চেয়ে অ্যাডমিশন ফেইজে অবশ্যই পড়ার সময় বাড়াতে হবে। কেননা, অ্যাডমিশন টেস্টে সারাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সেরাদের বাছাই করা হয়।
ফারাবি বলেন, একটা কঠিন ম্যাথ না পারলে র্যাংকের অনেক তফাত হবে না, কিন্তু সহজ কোনো ম্যাথ ভুল করলে চান্স পাওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাই বেশি বেশি অনুশীলন জরুরি। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে এক সপ্তাহ পর পুনরায় অ্যাক্টিভেট করে ফেলে। আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট কিংবা অ্যাপ আনইনস্টল করার পরিবর্তে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি। ইন্টারনেটের সুব্যবহার করতে হবে। গুগলের সাহায্যে অনেক কনফিউশন দূর করা যায়।
তিনি আরও বলেন, একটানা পড়তে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই একঘেয়েমি বা বিরক্তি আসবে। একঘেয়েমি দূর করতে শখের কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু তা অবশ্যই ইলেকট্রনিক ডিভাইস-অসংশ্লিষ্ট হতে হবে। আর এ বিরতির সময় যেন অনধিক হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
যারা আমার মতো মিডিয়াম লেভেলের শিক্ষার্থী, এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তোমরা শুধু বোর্ড এক্সামের জোরালো প্রস্তুতিই নাও। তোমরা কোনো টপিক স্কিপ করো না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ডেডিকেটেড কোনো প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন নেই। ভর্তি পরীক্ষায় অর্ধেকাংশই আসবে বোর্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন। বাকি অর্ধেক প্রস্তুতি নিতে হবে এইচএসসি পরীক্ষার পরে।
তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষার জন্য বিদেশি লেখকদের বইয়ে গুরুত্বারোপ না করে বাংলাদেশি বইগুলো পড়েই বেশ ভালো ফল অর্জন করা যায়। বোর্ড পরীক্ষার পর প্রকৃতপক্ষে নতুন কোনো কনসেপ্ট জানার কিছু থাকে না। কেবল টপিকগুলোর বারবার রিভিশন ও প্র্যাকটিস করাই হলো মূল কাজ। এজন্য কিছু সহায়ক বই এবং কোনো প্রতিষ্ঠানের মডেল টেস্টে অংশগ্রহণ করাও বেশ উপকারী।
বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় মূলত ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ ও ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে থাকে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথের জন্য প্রথমে মূল বইয়ের কনসেপ্ট ভালোমতো বুঝতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কন্সেপ্টচুয়াল প্রশ্ন সল্ভ করা যায়, তেমনই ম্যাথমেটিক্যাল প্রবলেম সলভ করতেও সুবিধাজনক হয়।
গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি বলেন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বিভিন্ন প্রবলেম সলভ করার অনুশীলন করতে হবে বেশি বেশি। কেমিস্ট্রিতে থিওরি পার্ট অনেক বেশি হওয়ায় গাণিতিক প্রবলেমের পাশাপাশি মূল বইও নিয়মিত আত্মস্থ করতে হবে। অ্যাডমিশন টেস্টে কেমিস্ট্রি পার্ট দিয়ে শুরু করা একটি ভালো স্ট্র্যাটেজি। এই অংশে ভাবার বিষয় কম থাকে, দ্রুত শেষ করা যায়।
ইংরেজি নিয়ে তিনি বলেন, ইংরেজির জন্য যেহেতু কোনো নির্ধারিত সিলেবাস নেই, তাই এক্সামের কিছুদিন আগে থেকে কেবল প্রশ্নব্যাংক প্র্যাকটিস করা ভালো। এক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক লাইফের ইংলিশ স্কিলই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।
সম্পূর্ণরূপে কোচিং-নির্ভর হওয়া উচিত নয় জানিয়ে এই বুয়েট শিক্ষার্থী বলেন, কোচিং সেন্টারের মডেল টেস্ট ও সহায়ক বইগুলো অনুশীলনের জন্য বেশ কার্যকরী। মডেল টেস্টগুলো এক্সাম হলে স্ট্রেস কমাতেও সহায়ক। টপিক দেখে ক্লাস করতে হবে; সহজ টপিকে ক্লাস করে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। তবে সম্পূর্ণরূপে কোচিং-নির্ভর হওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, মূল বইয়ের কনসেপ্ট না পড়ে শুধু কোচিং সেন্টারের বই বা নোট পড়লে হবে না। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার দীর্ঘ সময় একটানা ক্লাস নিয়ে হায়ার লেভেলের অপ্রয়োজনীয় কনসেপ্ট শেখায়। এগুলো স্কিপ করতে হবে।