নৃবিজ্ঞান: উচ্চশিক্ষার এক প্রগতিশীল পথ
- জুবায়ের রহমান
- প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ০৯:২৭ AM , আপডেট: ২৩ মে ২০২৫, ১২:১৩ PM
নৃবিজ্ঞান—নামটি শুনলে আজও অনেকের চোখে মুখে বিস্ময় ভেসে ওঠে। কেউ ভাবেন এটি বুঝি মাটি বা ফসিল নিয়ে পড়াশোনা, কেউ ভাবেন বিবর্তনবাদের কোনো শাখা। আবার কেউ তো বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ বা অনাগ্রহও প্রকাশ করেন। বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে এখনো নৃবিজ্ঞান সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা বা সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। অথচ এই শাস্ত্রটি মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, আচরণ, পরিবেশ ও বিকাশ সম্পর্কে জানার এক অনন্য পথ খুলে দেয়।
নৃবিজ্ঞান (Anthropology) হলো একটি বৈজ্ঞানিক ও মানবিক শাস্ত্র, যা মানুষের উৎপত্তি, বিবর্তন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সামাজিক গঠন এবং ভাষাগত প্রভাব বিশ্লেষণ করে। এটি কেবল অতীত নয়, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মানবজীবনের নানা দিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করে। আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বহির্বিশ্বে নৃবিজ্ঞান এমনকি এরোস্পেস, সাইবার সিকিউরিটি, চিকিৎসা, রাজনীতি ও প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এর মূল কারণ হলো এর হলিস্টিক বা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি—যা মানুষকে শুধু একপাশ থেকে নয়, বরং তার শারীরিক গঠন, ভাষা, সংস্কৃতি, আচরণ, ইতিহাস ও মানসিকতা—সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে সাহায্য করে।
নৃবিজ্ঞান অধ্যয়নের অন্যতম আকর্ষণ এর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিগত বৈচিত্র্য। যেমন, "হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ"—মানুষকে কেবল একটি দিক থেকে নয়, বরং তার জৈবিক গঠন, ভাষা, আচরণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজ এবং পরিবেশসহ সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিলিয়ে মানুষের চিন্তাধারা ও মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে গড়ে উঠেছে। আর এই জ্ঞানের যথার্থ ব্যবহার সাংবাদিকতায় করতে পারলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার শৈল্পিকতা ফুটে উঠবে। বিশেষ করে সংবাদকে অর্থবহ করে তুলতে নৃবিজ্ঞানের এসব দৃষ্টিভঙ্গির জুড়ি মেলা ভার।
এছাড়াও কালচারাল রিলেটিভিজম, তুলনামূলক পদ্ধতি, ইমিক ও এটিক অ্যাপ্রোচ, এনথ্রোসেন্ট্রিজম, পার্টিসিপেন্ট অবজারভেশন ও নৃবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহ—সবই নৃবিজ্ঞানের পাঠ ও চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নৃবিজ্ঞান অন্যান্য বিষয়ে তুলনায় অনেক বেশি সমসাময়িক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা একে বিশ্বজুড়ে একটি প্রভাবশালী ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিশেষ করে উপনিবেশ স্থাপন ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মূলত, অপরিচিত সংস্কৃতি অধ্যয়নের মাধ্যম হিসেবেই এই শাস্ত্রের জন্ম, যার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতিকে বুঝে নিজেদের স্বার্থে কৌশল নির্ধারণ করত। এই প্রভাব এখনও আমাদের সমাজে কমবেশি রয়ে গেছে।
কেন পড়বেন নৃবিজ্ঞান?
নৃবিজ্ঞান হলো মানব বিকাশ, সংস্কৃতি এবং বিশ্বজুড়ে অতীত ও বর্তমানের পরিবর্তনগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ ও প্রেক্ষাপনির্ভর অধ্যয়ন। এই শাস্ত্র আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা ও পরিকল্পনায় সহায়তা করে, যেখানে মানবিক ও পরিবেশগত জটিলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর চারটি প্রধান শাখা—সামাজিক-সাংস্কৃতিক, জৈবিক, ভাষাবিজ্ঞান ও প্রত্নতত্ত্ব—এর এই পূর্ণতা প্রকাশ করে।
নৃবিজ্ঞানের নিজস্ব পদ্ধতিগুলো মানুষের অভিজ্ঞতা ও আচার-আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদি নৃবৈজ্ঞানিক (ethnographic) গবেষণার মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরতা উদ্ঘাটন করেন। একজন দক্ষ নৃবিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে উঠতে শিখতে হয় কীভাবে সঠিক anthropological প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয় এবং মানুষের জটিল আচরণের মধ্যে নিহিত প্যাটার্ন বা ধারা শনাক্ত করতে হয়।
জৈবিক নৃবিজ্ঞানীরা এই সংযোগ খুঁজে পান মাঠ ও ল্যাব উভয় ক্ষেত্রেই। নৃবিজ্ঞানীরা প্রায়ই ইতিহাস, সাহিত্য, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞানসহ অন্যান্য শাস্ত্রের গবেষকদের সঙ্গে সংলাপে যুক্ত থাকেন। এই কারণে তারা নৃবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি পরিমাণগত জরিপ, ল্যাবভিত্তিক গবেষণা এবং টেক্সচুয়াল ও ভিজ্যুয়াল স্টাডিজের মতো মানবিক পদ্ধতিও প্রয়োগ করে থাকেন।
বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানের যাত্রা
বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিভাগ চালুর মাধ্যমে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান চালু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (IUB) উল্লেখযোগ্য।
এইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও অ্যাপ্লায়েড অ্যানথ্রোপোলজির প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, মানবাধিকার, লিঙ্গ, জাতিগত সংখ্যালঘু, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে নৃবিজ্ঞানীদের ভূমিকা ক্রমাগত বাড়ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
নৃবিজ্ঞান শুধু অ্যাকাডেমিক চর্চার বিষয় নয়; এটি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে—যেমন: সামাজিক বৈষম্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংকট, অভিবাসন সমস্যা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা। উন্নয়ন সংস্থা, এনজিও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নৃবিজ্ঞানীদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষায় নৃবিজ্ঞান একটি প্রগতিশীল ও মানবিক শাখা হিসেবে তরুণদের সামনে চিন্তাশীল ও অর্থবহ এক ভবিষ্যতের দ্বার খুলে দিচ্ছে।