‘প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের’ বাসের বকেয়া ভাড়া ২ কোটি টাকা

জাবি ক্যাম্পাস ও বাস
জাবি ক্যাম্পাস ও বাস   © সংগৃহীত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে (জাবি) প্রায় ১১ বছর আগে ৪টি বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ওই বাসগুলো প্রধানমন্ত্রীর অনুদান নাকি স্বল্প ভাড়ায় বরাদ্দ; তা নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) ও জাবি কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে জাবি প্রশাসনকে প্রায় ১৫ বার ভাড়া পরিশোধ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে বিআরটিসি। তবে কোনো সদুত্তর মেলেনি। বিআরটিসি জাবি প্রশাসনের কাছ থেকে বাস কিংবা বাসের ভাড়া কোনটিই পায়নি।

‘সমস্যাটি গত ১১ বছর ধরে চলে আসলেও সমাধান হয়নি সমাধান। বকেয়া ভাড়া ২ কোটির বেশি, বাসসহ বিআরটিসির ক্ষতি কোটির বেশি’

এদিকে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাবিকে দেওয়া বাসগুলো প্রধানমন্ত্রীর অনুদানে নয় বরং স্বল্প ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৯ জুন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের উপ-সচিব বদরুল আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠির অনুলিপি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, জাবি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ এবং বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।

এছাড়া একই বছরের ২২ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্য এক পত্রের বরাতে জানানো হয়, ‘আগামী ৫ জুলাই ২০১১ তারিখ সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চামেলিতে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাড়ায়/অনুদানে বাস প্রদানের সদয় সম্মতি প্রদান করেছেন।’ এই পত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বাসের পাশে ভাড়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৫ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে চারটি চায়না বাস উপহার দিয়েছেন বলে পরদিন গণমাধ্যমে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। যা সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

এরপর ২২ জুলাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) নিজ উদ্যোগেই চারটি বাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দেন। একই বছরের ৯ অক্টোবর বিআরটিসি বাস ডিপো মিরপুরের ম্যানেজার (অপারেশন) গোলাম ফারুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষককে চারটি বাস ক্রয় বাবদ গৃহীত ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য প্রতিটি বাসের জন্য দৈনিক ১৩০০ টাকা করে মোট ৫২০০ টাকা হারে ভাড়া প্রদানের কথা জানান।

‘এর আগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বাস চারটি ভাড়ায় চালিত স্বীকারপূর্বক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে একটি চিঠি লেখেন। তবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ ওই চিঠির বরাতে জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বল্প ভাড়ায় বাস বরাদ্দ দেওয়ায় তা মওকুফের এখতিয়ার বিআরটিসির নেই’

জানা গেছে, এরপর ২০১২ সালের ১১ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিআরটিসি চেয়ারম্যান এম ইকবালকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি তাগাদা পত্রের বিষয়ে জানান। তবে ওই পত্রের জবাবে একই বছরের ১৯ জুলাই বিআরটিসি চেয়ারম্যান বাসগুলোর বকেয়া অতিসত্বর পরিশোধ মর্মে বিআরটিসি’র সঙ্গে লিখিত চুক্তির বিষয়ে জানান। এক চিঠিতে একই বছরের ১২ নভেম্বর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা হলে পরে সে সময় তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের ০১ জুন বিআরটিসির মিরপুর বাস ডিপোর ম্যানেজার (অপারেশন) রাজিবুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাড়া প্রদানের প্রমাণকসহ জাবি কর্তৃপক্ষকে ১৪০৯ দিনের বাস ভাড়া ও ছাত্রদের দ্বারা বাস ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮০ লক্ষ ৫৬ হাজার ২০০ টাকা বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ জানান। পরে একই বছরের ১ নভেম্বর তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বাস চারটি ভাড়ায় চালিত স্বীকারপূর্বক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে একটি চিঠি লেখেন। তবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ ওই চিঠির বরাতে জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বল্প ভাড়ায় বাস বরাদ্দ দেওয়ায় তা মওকুফের এখতিয়ার বিআরটিসির নেই।’

পরে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিস থেকে জানানো হয়, সবগুলো বাস অচল হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ জাবি উপাচার্য বরাবর ডিও লেটার পাঠান। এরপর আরও দুইবার বিআরটিসি থেকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং দু’পক্ষের আলোচনার সুপারিশ করেন। এরপর ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ১ কোটি ৪৬ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬৮৮ টাকা জরুরি ভিত্তিতে পরিশোধ করতে বলা হয়।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সে টাকা পরিশোধ করেননি বলে জাবি পরিবহন অফিস ও বিআরটিসি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেই হিসেবে এখন পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার। এছাড়া ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের আরও দু’টি বাসসহ মোট ৬টি বাসের কোনটিই মেরামতযোগ্য বা বিক্রয়যোগ্য অবস্থায় নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, ‘বাসগুলো ক্রয় করার সময় এগুলোর প্রতিটির মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা ছিল। সে হিসেবে ৪টি বাসের মূল্য এক কোটি ২০ লক্ষ টাকা হয়। এতে বিআরটিসির সর্বমোট প্রায় তিন কোটি ২৩ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।’

বিআরটিসি’র মিরপুর দ্বিতল বাস ডিপোর সহকারী পরিযান ব্যবস্থাপক তানজিদ আলম খন্দকার জানান, ‘প্রজ্ঞাপনে ভাড়ার কথা বলা থাকায় আমাদের কিছু করার ছিল না। গত ১১ বছরে ভাড়া প্রদানের জন্য আমরা বহুবার তাগাদা দিয়েছি। সময়মত ভাড়া দিলে এত টাকা বকেয়া হতো না। তারপরও কিছুদিন আগে আমাদের ডিপো ম্যানেজার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন। ভাড়ার সুরাহা হলে আমরা হয়তো পরিত্যক্ত বাসগুলো ডিপোতে নিয়ে আসতে পারবো।’

আরও পড়ুন : সন্ধ্যা হলেই শুরু গাঁজা-ফেনসিডিল সেবন, চলে নারী-পুরুষের মেলামেশা

ভাড়ার ব্যাপারে তিনি আরও জানান, ‘সুরাহা না হলে আমরা তো ধরেই নেব বাসগুলো এখনো সচল রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে যতদিন পর্যন্ত সচল ছিল, এর একটা ভাড়ার প্রাক্কলন করতে পারেন।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘এটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমি গত ১৬ মে দায়িত্ব নিয়েছি। ইতোমধ্যে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার মহোদয়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা কথা বলে গাড়িগুলো নেবেন বলে জানিয়েছেন। বকেয়া ভাড়ার বিষয়টি দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করবো।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, ‘করোনা মহামারীর কারণে আমাদের অনেক কাজ বাকি ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছি। এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আমি জানতে পেরেছি। দু’টো প্রতিষ্ঠানই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হলেও বিষয়টি পুরনো ও জটিল হওয়ায় সমাধানে একটু সময় লাগতে পারে। তবে আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংস্থানের কথা চিন্তা করে বকেয়া ভাড়া মওকুফ করতে অনুরোধ করছি।’


সর্বশেষ সংবাদ