রাবি অধ্যাপকের নেতৃত্বে হারানো ঐতিহ্য ‘ঢাকাই মসলিন’ পেল বাংলাদেশ

রাবির গবেষক দলের তৈরি করা ঢাকাই মসলিন কাপড়
রাবির গবেষক দলের তৈরি করা ঢাকাই মসলিন কাপড়  © টিডিসি ফটো

১৭০ বছর পর ফের ‘ঢাকাই মসলিন’ বস্ত্রের মতো হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বাধীন একদল গবেষক। গত ২৮ ডিসেম্বরে–এ সংক্রান্ত এক গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি দেশবাসী দৃষ্টিগোচর হয়। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার নির্দেশ প্রদানের দীর্ঘ ছয় বছর পরে ঠিক সে রকমই কাপড় তৈরি করতে সক্ষম হলেন গবেষক দলটি। যেমনটি বলা হতো—আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় আস্ত একটি শাড়ি!

সেই পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার গল্পে এখন বাংলাদেশ! তবে তা ফিরে পেতে এই গবেষকদের পুড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখোট্টা এবং সহ্য করতে হয়েছে অনেক ধকল। কেননা প্রচলিত আছে, কেউ যেন ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে না পারে সেজন্য কারিগরদের আঙুল কাটা হয়। ১৮৫০ সালে লন্ডনে সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল এই মসলিন কাপড়ের, যা ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক ধরনের মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়ে তৈরি হতো এই মসলিন কাপড়।

অর্ধ যুগের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা শেষে কিভাবে সেই একই কাপড় পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। সেই গল্প শুনিয়ে প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও রাবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘মসলিন কাপড়ের নমুনা পাওযার পর সেই সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল আমাদের প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে মসলিন কাপড়ের কোনো নমুনা কিংবা ফুটি কার্পাসের চিহ্ন ছিল না। ছিল কেবল সুইডিস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’–এর মতো কিছু বই।’

কেবল এ তথ্যকেই পুঁজি করে ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে, এমন ধারণা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। পরে গাছটি খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে রাবির চারুকলা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে ছবি এঁকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পাশাপাশি বিটিভিতে প্রচার করেন। তার আলোকে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এ গাছের খবর আসে। তখন গবেষকরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পেলে সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এ জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠ এবং আইবিএসসির মাঠে চাষ শুরু করা হয় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আট টুকরা কাপড়ও সংগ্রহ করা হয়। তবে সেগুলোর কোনটি আসল মসলিন ছিলো না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হলে দীর্ঘ আটমাস অপেক্ষা করেও তা পাওয়া যায়নি।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাওয়া হয়। কিন্তু সেই মসলিন আসল ঢাকাই মুসলিন কাপড়ের মতো না হলে আমাদের মধ্যে নেমে আসে হতাশার ছাপ। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়। আমাদের ধারণা ছিল, কাপাশিয়া থেকে সংগৃহিত তুলার আঁশ যেহেতু বেশি শক্ত ও সাদা ধবধবে সেহেতু এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে।পরে লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ আমরা যখন মিলিয়ে দেখলাম, তখন আমাদের ধারণা মিলে গেল। কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটাই আসল ফুটি কার্পাস।’

ফুটি কার্পাসের সন্ধান মিললেও সেটা মসলিন কাপড়ে রূপ দেয়া ছিল আরো বড় চ্যালেঞ্জ- উল্লেখ করে প্রধান এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০-৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কেননা আধুনিক যন্ত্রে ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। যা করতে হবে চরকায় কেটে। এদিকে চরকায় সুতা কাটা তাঁতি খোঁজ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায় তাঁতি।’

কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন, যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনের প্রশিক্ষণ শেষে ছয় জনকে বাছাই করা হয়। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পাওয়া গেলেও তারা এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ কাপড় বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে অনেক কষ্টে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণ শেষে প্রস্তুত করা হয়।

সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। তিনটি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়। প্রথমে তাঁদের আঙুলগুলো শক্ত ছিল। অনুভূতি ছিল না। পরে তাঁদের আঙুলের ‘ট্রিটমেন্ট’ করতে হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা তিনটি আঙুলে লোশন মাখিয়ে রেখে সকালে সুতা কাটা হতো। আর সব সময় আঙুল তিনটির যত্ন নিতে হয়েছে। যাতে এ তিন আঙুলে কোনো আঁচড় না লাগে! আর এভাবে তাঁতি বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায় বলে জানান তিনি।

মসলিন কাপড়ের জন্য তৈরি করা হচ্ছে সুতা

এ বিজ্ঞানী জানান, বহু কষ্টে অবশেষে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করে এবং ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন এই তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়, যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়েছে।এছাড়া এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। তবে খরচ হয় মোট বরাদ্দের মাত্র ৩০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার আশা পোষণ করে অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন জানান, ইতোমধ্যে ঢাকাই মুসলিন জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এদিকে আমাদের যথেষ্ট লোকবল, সুতা, তাঁতও মজুদ আছে। সুতরাং খুব শিগগিরই দেশের হারিয়ে যাওয়া এই পুরোনো ঐতিহ্য পুনরায় গোটা দেশ তথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।


সর্বশেষ সংবাদ