চাকসু নির্বাচন

শিক্ষকের জিঘাংসায় বরবাদ ছাত্রজীবন, জয়ী হলে এই বিষয়ে নীতিমালা করবেন সোহাগ

২০২২ সালে আটকের পর জোবায়ের হোসেন সোহাগ
২০২২ সালে আটকের পর জোবায়ের হোসেন সোহাগ  © সংগৃহীত ও সম্পাদিত

নিজ বিভাগের শিক্ষকের জিঘাংসার শিকার হয়ে প্রক্টর কার্যালয়ে ১১ ঘণ্টা হেনস্তার পর জুটেছিল রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। তিন মাস কারাবরণ করতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন দুই বছরের জন্য। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্রাকারে বাস সার্ভিস চালু এবং সিএনজিচালক কর্তৃক শিক্ষার্থী হেনস্তার বিচার চাওয়ার অপরাধে ‘শিবির সন্দেহে’ এত বড় শাস্তি পেয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের হোসেন সোহাগ। এবার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে নির্বাহী সদস্য পদে স্বতন্ত্রভাবে লড়ছেন তিনি। নির্বাচিত হলে শিক্ষক কর্তৃক হেনস্তা বন্ধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে চান সোহাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট চক্রাকারে বাস সার্ভিস চালুসহ ৪ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে একটি মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। ওই মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন জোবায়ের হোসেন সোহাগ। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মী। ওই সময় সকাল ১০টার দিকে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া সবাইকে তুলে নিয়ে যায় প্রক্টরিয়াল বডি। প্রক্টরের কার্যালয়ে সবার বক্তব্য শোনার পর বাকিদের যেতে দেওয়া হলেও সোহাগকে চিহ্নিত করেন তার বিভাগের শিক্ষক হাসান মুহাম্মদ রোমান শুভ। তিনি ওই সময়ে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্বে ছিলেন।

আটকের পর ১১ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হেনস্তা ও মানসিক নিপীড়ন চালানো হয় সোহাগের উপর। তার ডায়েরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলার ছক পাওয়া গেছে বলে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়। একই সাথে জঙ্গি সংগঠনে জড়িত অভিযোগ তুলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে রাত ১০টার দিকে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে অধ্যাপক রবিউল হাসান ভুঁইয়ার নেতৃত্বাধীন প্রক্টরিয়াল বডি।

এরপর ৩ মাস কারাগারে ছিলেন সোহাগ। পরে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে একটি সিন্ডিকেট সভায় সোহাগকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কারের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রশাসনের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তবে ওই সময়ই নয়, জোবায়ের হোসেন সোহাগ আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের অধিকার সচেতন। তিনি ২০২২ সালে চবি শিক্ষার্থী সংসদ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য। এ ছাড়া আবাসন ও পরিবহন সংকট, অনিরাপদ ক্যাম্পাস, নারী শিক্ষার্থী নিপীড়নসহ নানা ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশ নিতেন তিনি। তবে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা নজরদারির কারণে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন সোহাগ। পরবর্তীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিলেও আন্দোলন বিতর্কমুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতেন তিনি।

এদিকে চাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। ইতোমধ্যে ইশতেহারও ঘোষণা করেছেন। সোহাগের ইশতেহার অনুযায়ী, আবাসিক-অনাবাসিক নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে সূলভ মূল্যে মানসম্মত পুষ্টিকর খাবারের অধিকার নিশ্চিত এবং সকল ক্ষেত্রে আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে চান তিনি। এ ছাড়া শতভাগ ও নিরাপদ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা, মেডিকেল সেন্টারের সেবার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত যানবাহন সচল করার উদ্যোগ নেওয়া, একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেশনজট নিরসন করা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি অথবা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করা এবং শাটল ট্রেনসহ সকল পরিবহনে নারী শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত নিশ্চিত করাও তার ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি।

তবে পৃথকভাবে কয়েকটি প্রতিশ্রুতি শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে। বিশেষ করে এসব প্রতিশ্রুতি সোহাগের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। এগুলো হলো-র‌্যাগিং, ট্যাগিং ও লেজুড়বৃত্তিক পেশিশক্তির রাজনীতি ফিরে আসার সকল পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, রাজনৈতিক কারণে হয়রানি ও নির্যাতনের সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করা, ধর্মীয় বিধান পালন, পোশাক বা সংস্কৃতির কারণে কোন শিক্ষার্থী যেন অন্য কোন শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অন্য কারো দ্বারা ন্যূনতম বাধা, কটাক্ষ বা হেনস্তার শিকার না হয় সে ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নের ব্যবস্থা করা, যৌন হয়রানি, সাইবার বুলিং ও স্লাটশেমিং প্রতিরোধে বিশেষ সেল গঠন করা এবং দ্রুত গতিতে অভিযোগ নিস্পত্তির ব্যবস্থা করা ও প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দান।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে জানতে চাইলে জোবায়ের হোসেন সোহাগ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি সব সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে তাদের অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে কাজ করেছি। সে জন্য আমি কোনো প্যানেলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। বিজয়ী হলে আমি আগে যে কাজগুলো করার চেষ্টা করেছি, সেগুলো আদায় করার চেষ্টা করব। আবাসন, পরিবহন, সেশনজট, মেডিকেল সংস্কার বা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার যে সংকট, এ ইস্যুগুলো ইশতেহারে এনেছি। এগুলো নিয়ে আগে থেকেই কাজ করে আসছি। কিন্তু তখন প্রশাসন আমাদের কথা শুনত না।

তিনি বলেন, যদিও নির্বাহী সদস্যের স্পেসিফিক কাজের কোনো ফিল্ড নেই, তারপরও যদি ম্যান্ডেট পাই, আমি আমার ইশতেহার বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। সংশ্লিষ্ট সম্পাদকীয় পদে যারা থাকবেন, তারা যদি এই কাজ না করেন, তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করা এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ঠিক রাখা- এই কাজটা আমি করব। তাদেরকে নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য করা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীবান্ধব কাজ করা আমার একটা দায়িত্ব হবে। আর প্রশাসনের চোখে চোখ রেখে কাজ আদায় করে নিতে চাই।

নিজের প্রতি হওয়া অবিচার তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২২ সালের মে মাসে চবি শিক্ষার্থী সংসদ নামে একটা প্লাটফর্মের অধীনে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীকে এঙ্গেজ করি। অফলাইনে-অনলাইনে আলোচনার মধ্য দিয়ে অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কথা বলতাম। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম। নারী হেনস্তার প্রতিবাদে বিচার চেয়ে আন্দোলন করেছি, ক্যাম্পাসে সিএনজিচালকদের দৌরাত্ম নিয়ে আন্দোলন করেছি। ওই বছরের ২৪ আগস্ট সিএনজিচালক কর্তৃক শিক্ষার্থী মারধরের প্রতিবাদে মানববন্ধন থেকে আমি গ্রেপ্তার হই। ১০ ঘণ্টা আটকে রাখার পরে রাত ১০টার দিকে আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর তিন মাস কারাবরণ করতে হয় আমাকে। পরবর্তীতে ২৩ সালের প্রথম দিকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কারাদেশ আসে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আমি প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছি এবং তাদের সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেছি। এই ধরনের বানোয়াট ভিত্তিহীন অভিযোগ দিয়ে তারা দমন-পীড়ন চালিয়েছে আমার উপর।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে সোহাগ বলেন, জুলাইয়ের প্রথম দিকে আমি মাঠে ছিলাম না। আমার বিরুদ্ধে মামলা ছিল সন্ত্রাসবিরোধী আইনে, ফলে আমি সব সময় গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলাম। আমি কোথায় থাকতাম, কাদের সাথে মিশতাম- সব কিছু তারা জানত। এজন্য প্রথম দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমি অংশ নিইনি। যখন দেখেছি যে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে, তখন আমি যোগ দিয়েছি এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এ সময় আমি অন্যদের সেফটির জন্য, আন্দোলন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য ছবিও এড়িয়ে চলেছি।


সর্বশেষ সংবাদ