ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এ যেন সর্বজনীন ঈদ আনন্দ
- ফাইয়াজ উদ্দিন স্মরণ, ঢাবি
- প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২৫, ০৯:৪৫ AM , আপডেট: ১০ জুন ২০২৫, ১২:১৫ AM
ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও এর আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সকল ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। এটা শুধু মুসলমানদের উৎসব নয়, এটি আমাদের সমাজের ধর্মীয় সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্মানের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ভিন্ন ধর্মের মানুষ হয়তো নামাজ পড়ে না, কিন্তু তারা বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা এবং সম্প্রীতির মাধ্যমে ঈদের আনন্দে শরিক হন।
এ বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৪ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত মোট ১১ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীরা ছুটে গেছেন নিজ নিজ বাড়িতে, পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে। জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরাও ফিরেছেন নিজেদের শেকড়ে। যদিও ঈদ ধর্মীয়ভাবে তাদের উৎসব নয়, তবুও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন তারা। তারা ঈদকে কেমন ভাবে উপভোগ করে, এটা জানতে কথা হয় কয়েকজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সাথে। সেখানে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন।
জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী সৌরভ বকশি বলেন, ‘বছরে হাতে গোনা কিছু সময়ই আমরা পরিবারকে পুরোপুরি কাছে পাই। ঈদুল আজহার ছুটিটা তাদের মধ্যে অন্যতম।শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, এই ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সব ধর্মের মানুষদের মাঝেও। যেমন আমি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছি কবে ঈদ আসবে, কবে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি দেবে আর আমি আমার প্রিয়জন, মা-বাবার কাছে ফিরে যাব।’
তিনি বলেন, ‘বছর ঘুরে আবারও আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই সময়টা যেমন ত্যাগের, ঠিক তেমনি আনন্দেরও। এই আনন্দ যেন সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যায় আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। আমরা যারা পড়াশোনার প্রয়োজনে পরিবার থেকে দূরে, অন্য শহরে বা এলাকায় বসবাস করি, তাদের জন্য এ সময়টা বাড়তি এক আবেগের।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছুটিতে বাড়ি ফিরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনদের সঙ্গে সময় কাটানো এক অন্যরকম আনন্দের। শহরের কোলাহল আর ধুলোর ক্লান্ত পরিবেশ ছেড়ে গ্রামীণ, শান্ত,নির্মল প্রকৃতিতে ফিরে এক ধরনের প্রশান্তি খুঁজে পাই। আবারও নতুন করে শহরে ফিরে পড়াশোনা আর জীবনের সংগ্রামে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার শক্তি সঞ্চার হয়। ত্যাগের মহিমায় ভরে উঠুক আমাদের হৃদয়। ঈদ হোক শান্তি, ভালোবাসা আর সম্প্রীতির প্রতীক।’
জগন্নাথ হলের আরেক শিক্ষার্থী মৃত্যুঞ্জয় সরকার পিয়াল বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি উৎসবের কোনো দেয়াল থাকা উচিত নয়। ঈদ এলে আমার চারপাশের পরিবেশটাই বদলে যায়। পাড়া-প্রতিবেশী,সহপাঠী,বন্ধুরা নতুন জামাকাপড় পরে,ঘরে ঘরে রান্না হয় সেমাই,কোরমা, পোলাও। আমি এই আনন্দের একজন সক্রিয় অংশীদার হতাম। ঈদের দিন সকালে আমি আমার মুসলিম বন্ধুদের ‘ঈদের শুভেচ্ছা' জানাই । কেউ কেউ আগে থেকেই আমাকে দাওয়াত দিত। তাদের বাসায় গিয়ে দেখতাম এক আনন্দময় পরিবেশ। সবাই হাসছে, গল্প করছে,খাওয়া-দাওয়া চলছে।আমিও বসে তাদের সাথে, মিষ্টি,সেমাই খেতাম। ওদের পরিবার থেকেও আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা পেতাম, বাইরে ঘুরতে যেতাম বন্ধুদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘কখনো মনে হয় নি আমি আলাদা। ঈদের আসল সৌন্দর্য এখানেই। ধর্মের ভিন্নতা থাকলেও ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর সম্মান এক করে দেয় আমাদের। আমি মনে করি, এই উৎসব আমাদের সহনশীলতা শেখায়, শেখায় কেমন করে একে অপরকে সম্মান জানাতে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমি ঈদ উদযাপন করি। হয়তো নামাজ পড়ি না, কিন্তু বন্ধুত্ব আর ভ্রাতৃত্বের প্রার্থনায় আমি ঠিকই শামিল হই।কিন্তু ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পরছে। যার কারণে বিভাজন তৈরী হচ্ছে। আগের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।’
সৌরভ কান্তি দাস নামে আরেক ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঈদ যেহেতু আনন্দের বিষয় তাই এই আনন্দটা সবার বলে আমি মনে করি । ঈদের ছুটির বাড়িতে যাব। পরিবারের অন্যারাও যারা বাইরে থাকে তারাও আসবে। সবার সাথে দেখা হবে। এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করে। তাই ঈদের ছুটি হোক বা পূজার ছুটি আমার কাছে দুটিই আনন্দের।’
তবে ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাসের পরিবেশটা একটু ভিন্ন মন্তব্য করে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাস অনেকটাই ফাঁকা থাকে। তখন পরিচিত ক্যাম্পাস অপরিচিত মনে হয়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার জন্য ছুটিতে আর বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠে না। তবে ক্যাম্পাসে যে সব মুসলিম বন্ধু থাকে, যখন তাদের সাথে দেখা হয্ তখন আবারও সেই প্রশান্তির সন্ধান পাই। হয়তো তাদের সাথে নামাজ পড়া হয় না , কিন্তু ঈদকে ঘিরে সব ধরণের অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করি। এভাবেই ধর্মীয় দেওয়াল ভেদ করে আমরা এক হয়ে উঠি।’