ক্ষমতার পূজারী থেকে জ্ঞানমন্দির হতে পারবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।

তবে, এই সক্রিয়তার একটি অংশ অতিরিক্ত রাজনৈতিক ঝোঁকের দিকে ধাবিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালকে ‘ক্ষমতার পূজারী’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের অতি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, প্রশাসনিক অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তার মৌলিক শিক্ষার জায়গা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে ‘ক্ষমতার পূজারী’ থেকে ‘জ্ঞানমন্দির’ হতে পারবে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঢাবি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ছাত্র আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য আজও বিদ্যমান, যার ফলে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক বিষয়ে সক্রিয় থাকার প্রবণতা দেখা যায়। 

রাজনৈতিক বিষয়ে সক্রিয়তার কারণে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সকলেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠনগুলো প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্যাতন, ভিন্ন ছাত্রসংগঠনের উপর হামলা, শিক্ষক নিয়োগ এবং বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে। 

আরও পড়ুন: আন্দোলনে বন্ধ ঢাবির মেডিকেল সেবা ও লাইব্রেরি, ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

তবে সেই গতি প্রকৃতির থেকে ১০০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বদলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষাদানমূলক এবং ঐক্য বা সমতামূলক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এটি একটি তদারকিমূলক ও অধিভুক্তিমূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষাদানের লক্ষ্য থেকে সরে গেছে।

বিশেষত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণতন্ত্রের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। এটি পূর্ববঙ্গে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করেছিল, যা ছিল সময়ের চাহিদা। পাকিস্তান আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে।  

গবেষণায় পিছিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ গবেষণা। উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতেও গবেষণা অন্যতম পূর্বশর্ত। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। ১০৪ বছর পেরোনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গবেষণায় ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বছর তাদের গবেষণা ব্যয় ছিল ৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে ওই বছর ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী ও দুই হাজার ২৯৯ জন শিক্ষকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় ব্যয় ছিল মাত্র ১৫ কোটি টাকা।

এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জমি আর অর্থের ব্যবস্থা যেভাবে হয়েছিল

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, মন্ত্রী পরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রী ভালো বলতে পারবেন কেন শিক্ষাখাতে এত কম টাকা বরাদ্দ দেয়া হল। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে গবেষণা এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি টাকা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এখনও কোন রাজনৈতিক নেতা কিংবা সরকার প্রধান এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি।

শিক্ষকদের রাজনীতিতে মনোযোগ, রয়েছে প্রশাসনিক পদে লোভ
বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত যে পাটাতন, সেটি শিক্ষক সমিতি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর থেকেই শিক্ষকরা সরকারি দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে।শিক্ষক সমিতিই ছিল ‘সাধারণ’ শিক্ষকদের আঁকড়ে থাকা জমিন, শিক্ষকেরা এটিকে তাঁদের শক্তি মনে করতেন; যদিও এটি সেই দলীয় লেজুড়ভিত্তিতে হারিয়ে গেছে। 

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য️সহ শীর্ষ পদগুলোর সিঁড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। গত এক দশকে এই সমিতিতে যারাই আওয়ামীপন্থী নীল দল থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন পরবর্তীতে তারাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ️পদ তথা উপাচার্য️, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে এসেছেন। এছাড়া এই সময়ে ঢাবির শীর্ষ️ পদগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তরাও এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক বিজ্ঞপ্তিতে ৩৩ ভুল!

শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষক রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন এমন ব্যক্তিরা  বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপদ পেতে শিক্ষকরা সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্যই তারা এই দলীয় অবস্থান নেন। প্রশাসনিক পদে উপরে উঠার জন্য শিক্ষক সমিতি তাঁদের জন্য বড় সিঁড়ি| অনেক সময় একাডেমিক জায়গায় ফোকাস না করে দলীয় লেজুড়ভিত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। 

আবাসন সংকট 
ঢাবির গণরুমে বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব শিক্ষার্থীদের জেলখানায় কারাবন্দি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা না থাকলেও রয়েছে তার চেয়েও ভয়াবহ গণরুমে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা।

দেশের কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম জায়গা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৬ ফুট করে। আর স্কয়ার ফিট (বর্গফুট) হিসেবে সেটি দাঁড়ায় ৩৬-এ। কিন্তু ঢাবির আবাসিক হলের গণরুমের থাকার জন্য একজন শিক্ষার্থী গড়ে ১৬ থেকে ১৭ স্কয়ার ফিট থাকার জায়গা পান। ফলে কারাগারে থাকা একজন কয়েদির অর্ধেক জায়গাও পান না গণরুমের শিক্ষার্থীরা। ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা সিট বরাদ্দ পায় না , অনেককে জোর করে ছাত্রসংগঠনের প্রোগ্রামে যেতে বাধ্য করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সকল রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরসঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র সংগঠন, এবং অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে হবে বলেও মত দেয়া হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, বাংলাদেশের যত কিছু শুভ, যত কিছু কল্যাণকর, সব কিছুর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব জড়িত। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয়ে বলা হচ্ছে। গবেষণার জন্য ফান্ডিংয়ের একটা বিষয় আছে। সরকার যদি ফান্ডিং না দেয় তাহলে কিভাবে গবেষণা হবে? সরকারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাফল্য ও সক্ষমতা সেটার সদ্ব্যবহার করা উচিত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনভেস্টমেন্ট বাড়ালে জাতি উপকৃত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো থাকলে বাংলাদেশ ভালো থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসলে আমরা বায়ান্ন, উনসত্তর এবং একাত্তরের কথা বলি। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব ছিল সেটা আমরা সুচারুভাবে পালন করেছি। কিন্তু একাত্তরের পরে আমাদের কাজ হওয়ার কথা ছিল বিশ্বায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। সমগ্র বিশ্বে উচ্চশিক্ষার যে ধারণা রয়েছে বৈশ্বিক হওয়ার সে ধারায় আমরা অনেকটা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের যে পরিবর্তন এসেছে সেটা ইতিবাচক হয়নি বরং সেটা নেতিবাচক হয়েছে।

আরও পড়ুন: শৌচাগার পরিষ্কার থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন— সবকিছু বন্ধের হুঁশিয়ারি ঢাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের

“এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটিকে রাজনৈতিকরণ করে ফেলেছি। যেখানে ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষক নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। বৈশ্বিকভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ন্যূনতম তিনটি স্তরে বিভক্ত। কিন্তু আমরা সে ধরনের কোনো স্তর আজ পর্যন্ত করতে পারিনি।”

তিনি বলেন, অতি রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে শিক্ষকরা এখন আর কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। তারা গবেষণার চেয়েও বেশি সময় রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন। কারণ সবাই চায় পরবর্তীতে বড় পদে যেতে। ফলে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাহলে তার পরবর্তী গন্তব্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিক্ষকদেরকে শিক্ষা গবেষণা থেকে আমরা রাজনৈতিক সাইডে লেলিয়ে দিয়েছি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমিয়ে ফেলা হচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence