‘আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম, কাল হয়তো পৃথিবী’
- রাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০২:১৯ PM , আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০২:২৮ PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সিকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বহিষ্কৃতদের মধ্যে একজন রাজু আহমেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং শেরেবাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।
দল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার প্রায় দেড় মাস পর শনিবার (৩০ সেপ্টম্বর) রাতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন রাজু। সুষ্ঠ তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সিদ্ধান্তে আসা উচিত ছিল এবং এভাবে বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টের উল্লেখ করে পোস্টে আত্মহত্যার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
দীর্ঘ ওই ফেসবুক পোস্টে রাজু আহমেদ লিখেছেন, ‘‘আমি মারা গেলে সত্য কেউ জানবেন না। তাই ১৭ আগস্টের ঘটনাটা সবার জানা উচিত। অনেক সাধের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমার, আজ ছেড়ে চলে যাচ্ছি সামান্য একটা ঘটনার জন্য। অনেক আশা নিয়ে ছিলাম হয়তো ভালো কিছু হবে। আমি রাজনীতি করতাম, কিন্তু কখনো ডিসকলেজিয়েট তকমা লাগতে দেইনি। আজ আমার ব্যাচমেটরা আমাকে ছাড়াই পরীক্ষায় দিচ্ছে। ভালো থাকুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ভালো থাকুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।’’
ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘১৭ আগস্ট প্রক্সি ঘটনার আগের রাতে আনুমানিক ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে মহিবুল মমিন সনেট (প্রক্সিকাণ্ডে অভিযুক্ত ও বহিষ্কৃত) ফোন করে বলে যে, ওর ছোট ভাই ভর্তি হবে সেখানে একটু কাজ আছে। আমি বললাম, সময় পেলে যাব।
‘‘পরেরদিন সকাল ৯টা ১৫ মিনিট থেকে পরপর দুইটা ক্লাস করি। ১২টার সময় ছাত্রলীগের নিয়মিত প্রোগ্রাম সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করি। আমি শেরে বাংলা ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম এবং ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করতাম। সেই সূত্রে ওরা আমার কাছে আসে।’’
‘‘ঘটনার দিন প্রতিদিনের ন্যায় আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে মমতাজের সামনে বসেছিলাম। সেই মুহুর্তে সনেট আসলো আমার কাছে। সনেট আমার ব্যাচমেট। এসে বলল, ‘রাজু আমার এক ছোট ভাই হাবিব আসছে ভর্তি হওয়ার জন্য পপুলেশন সায়েন্সে। এখন ভর্তি কার্যক্রম চলছে। চলো তার সাথে দেখা করে আসি। তাহলে সে খুশি হবে এবং পরিচয় করিয়ে দেব তোমার সাথে’।
তারপর সনেট নিয়ে যায় হাবিবের কাছে, পরিচয় করিয়ে দেয় এবং ওখানে গিয়ে প্রাঙ্গনের (প্রক্সিকাণ্ডে অভিযুক্ত ও বহিষ্কৃত) সাথে দেখা হয়। তারপর হাবিবকে শেরে বাংলা হল দেখানোর জন্য সনেট ও প্রাঙ্গন নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে। আমিও তাদের সাথে নিয়ে শেরে-বাংলা হলে যাই। হলে আসার পর সনেট ও প্রাঙ্গন ২ জনেই হাবিবের সাথে টাকা নিয়ে আলোচনা করে। হাবিবের নিকট চুক্তির টাকা পাবে, সেটার ব্যাপারেই কথা বলছিল। তখন তারা ওই শিক্ষার্থীর বাড়িতে ফোন দিয়ে তিন লাখ টাকাও দাবি করে।’’
আরও পড়ুন: রাবিতে প্রক্সি দিয়ে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হতে এসে আটক
তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘তাদের কাছ থেকে জানতে পারি, হাবিব প্রক্সি দিয়ে ভর্তি হয়েছে এবং এই বিষয়ে তারা টাকা দাবি করছে হাবিবের কাছে। যখন আমি বিষয়টা বুঝতে পারি যে, এদের ভেতরে ঝামেলা আছে। তাৎক্ষণিক তাদের হল থেকে বের করে দেই। আমি নিজেও হলের বাইরে বেরিয়ে আসি। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন মেয়র লিটন ভাই আসবে, সেজন্য কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে এয়ারপোর্টে যাব।
এরপরেই প্রভোস্ট হাবিবুর রহমান রাসেল স্যার কল দিয়ে জানতে চান, হলে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না? তখন আমি বিষয়টা স্যারের সাথে শেয়ার করি এবং বলি স্যার, ওদেরকে হল থেকে বের করে দিয়েছি। স্যার আমাকে দায়িত্ব দেন যেন আমি হাবিবকে যেভাবেই হোক বের করে স্যার অথবা প্রক্টরের কাছে তুলে দেই।
এর মাঝে আমি প্রক্টর স্যারকে ফোন দিয়ে পরিচয় দেওয়ার পর স্যারও একই প্রশ্ন করেন। পরবর্তীতে ওদেরকে ডেকে আমি আমার হলের প্রভোস্ট হাবিবুর রহমান রাসেল স্যার ও সহকারী প্রক্টর হাকিমুল ইসলাম স্যারের কাছে সৌপর্দ করি। স্যার প্রাথমিক জিজ্ঞেসাবাদ করার পর প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। নিয়ে যাওয়ার পর আনুমানিক আটটার দিকে প্রক্টর অফিসের নম্বর এবং হাকিম স্যারের নম্বর থেকে আমার ফোনে কল আসে। কিন্তু আমি রিসিভ করতে পারিনি। কল ব্যাক করলে স্যার আমাকে প্রক্টর অফিসে ডাকেন। আমি তাদের কথামত সেখানে যাই। যেয়ে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আসি।’’
সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে তিনি লিখেছেন, ‘‘এখন আমার তিনটা প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, আমি যদি প্রক্সির সাথে জড়িত থাকতাম, তাহলে আদৌ কি ওই ছেলেকে প্রক্টর ও প্রভোস্ট স্যারের কথামত তুলে দেয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতাম নাকি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম? দ্বিতীয়ত, প্রক্সির সাথে জড়িত থাকলে পরবর্তীতে কি এমন সাহস নিয়ে প্রক্টর অফিসে এক্সপ্লোরেশন দিতে যেতাম? তৃতীয়ত, আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছি, এখন সহযোগিতা করাই কি আমার অপরাধ?
আমার ফোনের কললিস্ট, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ইমো এবং টেলিগ্রাম আপনাদেরকে ওপেন করে দেই। যদি এই ছেলের প্রক্সি কিংবা কোনো ধরনের কোনো প্রক্সির সাথে জড়িত থাকার তথ্য পান তাহলে আমাকে যে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে, এটাকে স্থায়ী বহিষ্কার মেনে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে আজীবনের জন্য চলে যাব। আমাকে আইন অনুযায়ী যে শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নেব।
আমার প্রক্সির সাথে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। ওরা আমার হলে এসেছিল, ঘটনাক্রমে বিষয়টি জানতে পেরে ওই ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে দিয়েছি, এটাই আমার অপরাধ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমার আকুল আবেদন উক্ত ১৭ তারিখের ঘটনার পুরো বিষয় তদন্ত করে সঠিক দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। আমার অপরাধ যতটুকু ততটুকু শাস্তি দিক, আমি মাথা পেতে নেব।’’
পোস্টের শেষাংশে আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। আমাকে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেন। আমি বাঁচতে চাই, মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনের উচিত ছিল, সুষ্ঠ তদন্ত করে তারপর সিদ্ধান্তে আসা।
আমি হয়ত মরে যাবো, আমার কাছে এভাবে বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টের। আমি কোনোভাবে আর বাঁচতে পারতেছি না। একটা খুব সিম্পল জিনিস আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম, কাল হয়ত পৃথিবী। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমার পরিবার, কারো কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি, কোনোভাবেই এই মিথ্যা প্রক্সির অভিযোগ নিয়ে থাকতে পারছি না।
ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মানুষ। ভালো থাকুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন। যাদেরকে আমি সহযোগিতা করার পরও তারা আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমার শুধু এতটুকুই আক্ষেপ থেকে যাবে, আমি হয়ত মরে যাব, এই ঘটনা উদঘাটনও হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্তের অভাবে আমার বাবা-মা হারাবে আমাকে। আর আমি হারাবো আমার সার্টিফিকেট। যেটার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। তন্ময় ভাই কিংবা সাফোয়ান সিদ্দিক এদের কারোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’
একই পোস্ট ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামক একটা ফেসবুক গ্রুপেও করেছেন তিনি। ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন।
আরও পড়ুন: রাবিতে ভর্তি জালিয়াতি: ছাত্রলীগ নেতাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা
শাহ মাখদুম হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রামিম আহমেদ রুপম লিখেছেন, ‘রাজু দুনিয়াতে এর বিচার না হলে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা এর বিচার করবেন। শুধু তুই না, কয়েকজনের জীবন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বিনা দোষে সম্মানহানি করেছে আমাদের সেই প্রিয় নেতা এবং আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুধুমাত্র ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু তারা জানে না, কয়েকটা পরিবার দিনে-রাতে তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে বদদোয়া দিচ্ছে।’
রেজওয়ান গাজি মহারাজ নামে একজন লিখেছেন, যারা এই নাটকের পেছনে ছিলো, তাদের নামগুলো প্রকাশ কর একটু। তোর যে একদমই দোষ নেই, বিষয়টা কিন্তু তেমন না।
মো. শরিয়তুল্লাহ নামে একজন রাজু আহমেদের সমালোচনা করে লিখেছেন, একটা নিরীহ আবাসিক ছেলেকে শেরে বাংলা হল থেকে বের করে দিয়েছ। ওইদিন কখনো তোমার কল্পনায় আসেনি, ওই ছেলেটা কতটা অসহায় হয়ে আল্লাহর কাছে তোমার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করেছে, চোখের পানি ফেলেছে। হল দাপিয়ে বেড়ানো ছেলে আজ নিজের জীবন নাশের হুমকি দেয়। পাপ বাপকে ছাড়ে না। পাপ করেছ, এখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।