শিক্ষক জনির কোনো অপরাধের বিচার করেননি জাবি ভিসি

অধ্যাপক মো. নূরুল আলম ও মাহমুদুর রহমান জনি
অধ্যাপক মো. নূরুল আলম ও মাহমুদুর রহমান জনি  © ফাইল ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর প্রায় একবছর অতিবাহিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম নিজেই শিক্ষক জনির অসদাচরণের শিকার হয়েছেন। এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা। তারা বলছেন, আগের অপকর্মের শাস্তি না হওয়ায় তিনি (জনি) এখন লাগামহীন হয়ে পড়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষক জনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম ‘গড়িমসি’ করছেন। এর আগেও তিনি তার অপরাধের কোনো শাস্তি দেননি। এছাড়া জনির বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতি মানা হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো মিটিং হয়নি। তবে কবে বসা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। -আবু হাসান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে চাকরির প্রলোভনে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে। গত বছরের ২১ নভেম্বর মাহমুদুর রহমান জনি ও একই বিভাগের প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচির একটি অন্তরঙ্গ ছবি (সেলফি) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়।

ললিপপ হাতে জাবি শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষিকার সেলফি, ক্যাম্পাসে পোস্টারিং

এর প্রেক্ষিতে জনির বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। পরে ৮ ডিসেম্বর একাধিক ছাত্রীর সাথে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে জনির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন জনি।

এছাড়া জনির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। পরে জনির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তখন আগের কমিটির রিপোর্ট পূর্ণাঙ্গ হয়নি মর্মে ১৩ মার্চ পুনরায় স্পষ্টীকরণ কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে তার বিচার হোক। আবার আমাদের সহকর্মী হিসেবে সে যদি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে আইনী সুরক্ষা দেয়া হোক। 

এরপর স্পষ্টীকরণ কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে গত ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়। তবে কমিটি গঠনের পর ৪০দিন অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এমনকি কমিটি গঠনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়মিত সিন্ডিকেট সভা ও জরুরি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে জনির বিষয়টি উত্থাপন করা হয়নি। ফলে জনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গড়িমসি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা। তবে উপাচার্যের ‘গড়িমসি’র পেছনে কয়েকজন শিক্ষকের ‘চাপ’কে দায়ী করছেন তারা।

এদিকে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি খামে উপাচার্যকে গালিগালাজ করার অডিও ক্লিপ সম্বলিত ডিভিডি, একটি দায়মুক্তিপত্র প্রত্যাহারের আবেদন ও একটি উড়োচিঠি সাংবাদিকদের পাঠানো হয়। ৫২ সেকেন্ডের ওই অডিও ক্লিপে মাহমুদুর রহমান জনিকে ‘অস্বাভাবিক’ কণ্ঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শোনা যায়।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার-পাঁচটা মুখ শেষ করে দেবেন বলে হুমকি দেন তিনি। এমনকি তার কারণেই অধ্যাপক মো. নূরুল আলম উপাচার্যের চেয়ারে বসেছেন বলে অডিওতে মন্তব্য করেন জনি।

এছাড়া ‘যৌন নিপীড়ক জনিকে বাঁচাতে তৎপর উপাচার্য, নেপথ্যে...’ শিরোনামে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান রীতি অনুসারে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিললে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়। তবে জনির ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। সে বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা কথা বললে সিন্ডিকেটের সভাপতি (উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম) সুকৌশলে জনিকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। তখন অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল ধরনের কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। তবে মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি তিনি শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বহাল তবিয়তে থাকায় তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’র বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

জাবির নতুন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম - banglanews24.com

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্যকে গালাগালি করা ও উপাচার্য পদে নিয়োগে জনির প্রভাব থাকার এমন ন্যাক্কারজনক অডিও ফাঁসের পরেও যদি তিনি (উপাচার্য) তার বক্তব্য এখনো স্পষ্ট করেননি। এছাড়া এ ঘটনায় তিনি যদি কোনো ব্যবস্থা না নেন তাহলে সবাই বুঝবে যে জনি যা বলেছেন—তা সত্য।

উপাচার্য পদ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, তিনি (উপাচার্য) যদি এ ঘটনায় জনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন তাহলে তিনি তার উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারাবেন। তিনি সবসময় তার কাছের শিক্ষকদের নানা অপকর্মে নীরব থেকেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন। উপাচার্যের এমন আচরণের কারণেই তারা এসব অপকর্ম দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে বারংবার ঘটাচ্ছে।’

শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে তার বিচার হোক। আবার আমাদের সহকর্মী হিসেবে সে যদি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাকে আইনী সুরক্ষা দেয়া হোক। তবে আমি বলতে চাই জনির অডিওর বিষয়টি যদি সত্যি হয়ে থাকে, আর এর পরেও উপাচার্য যদি কোনো ব্যবস্থা না নেন তাহলে তিনি তাঁর পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছেন।’

উপাচার্য যদি এ ঘটনায় জনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন তাহলে তিনি তার পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারাবেন। -অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, জাবি

এ বিষয়ে স্ট্রাকচার্ড কমিটির সদস্য ও পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সভাপতি মাহফুজা মোবারকের কাছে জানতে চাইলে তিনি অসুস্থতার জন্য কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে এর আগে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আমি স্ট্রাকচার্ড কমিটিতে আছি তা শুনেছি, তবে আমাকে অফিসিয়ালি কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।

স্ট্রাকচার্ড কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) রেজিস্ট্রার আবু হাসান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো মিটিং হয়নি। তবে কবে বসা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এছাড়া সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence