৩৩ বছর ধরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ইতিহাস-স্মারক রাবির ‘সাবাস বাংলাদেশ’

'সাবাশ বাংলাদেশ' নব প্রজন্মের কাছে এক স্মৃতির মিনার
'সাবাশ বাংলাদেশ' নব প্রজন্মের কাছে এক স্মৃতির মিনার  © টিডিসি ফটো

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী যুবকদের অসীম সাহসীকতা আর বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশ দ্বার থেকে উত্তর-পশ্চিমে এবং শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনের দক্ষিণ পাশের মাঠে তৈরি করা হয়েছে 'সাবাশ বাংলাদেশ' নামে অনিন্দ্য সুন্দর একটি ভাস্কর্য। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যে কয়টি ভাস্কর্য এ যাবৎ স্থাপন করা হয়েছে 'সাবাশ বাংলাদেশ' তার মধ্যে অন্যতম একটি বৃহৎ ভাস্কর্য। 

সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক বাংলার চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতিফলন এ ভাস্কর্য। ৪০×৪০ ফুট জায়গার ভিতরে যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ ভাস্কর্যে। ভাস্কর্যটি প্রকাশভঙ্গির সরলতা আর যুদ্ধের গতিময়তার জন্য কুড়িয়েছে বহু সুনাম।

এটি নব প্রজন্মের কাছে এক স্মৃতির মিনার। সাহস যুগিয়ে চলেছে সামনে পথ চলার। এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায় তরুণ-তরুণীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ (১২ চৈত্র ১৩৯৬) স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ। শিল্পী নিতুন কুন্ডুর শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় লাল বেলে মাটি দিয়ে ১৯৯১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১০ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ (২৭ মাঘ ১৩৯৮) সালে এ ভাস্কর্যটি উন্মোচন করেন শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম।

৬ ফুট বেদীর উপর স্থাপিত মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দুজন তরুণের ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের মহান অবদানের কথা। একজনের পরনে আছে প্যান্ট আর অপরজন লুঙ্গি, যা মুক্তিযুদ্ধে সর্ব-সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। 

একজনের একটি হাতে রাইফেল আর অন্য হাত মাথার ওপরে মুষ্টিবদ্ধ, যা দেশকে স্বাধীন করতে বাঙালিদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও মনোবলের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অন্যজনের দুই হাতে আছে রাইফেল, যা দ্বারা জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সর্বশক্তির সাথে রণাঙ্গনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিশেষ এক মুহূর্ত নান্দনিকভাবে উপস্থিত করা হয়েছে।

ভাস্কর্যটির দু'পাশে রয়েছে আয়তাকার দুটি দেওয়াল। একটিতে কয়েকজন বাউল একতারা বাজিয়ে গান করছে। যা বাঙালী জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। অন্যটিতে মায়ের কোলে শিশু ও দুজন তরুণী, একজনের হাতে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার দিকে অবাক তাকিয়ে আছে এক কিশোর। ভাস্কর্যটির নিচে লেখা আছে তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত দুইটি চরণ, 'সাবাশ,বাংলাদেশ,এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।' ভাস্কর্যটির পাদদেশে আছে একটি মুক্তমঞ্চ। 

৪০ বর্গফুট এ ভাস্কর্যের ঠিক পিছন পাশে রয়েছে ৩৬ ফুট উচ্চতার একটি বৃহৎ দেয়াল। তার মাঝে আছে ৫ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্ত। যেটি স্বাধীনতার সূর্যের প্রতিকস্বরূপ। ভাস্কর্যটির পাদদেশে রয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। পুরো ভাস্কর্যটি একটি বিশাল বেদির ওপর স্থাপিত। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে ভাস্কর্যের মূল বেদি। 

সাবাস বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম শহিদ বলেন, "সাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্য আমাদের তারুণ্য, অহংকার ও গৌরবের প্রতীক। বাঙালি জাতি যে কখনও কারো কাছে মাথা নোয়াবার নয়, সে দীক্ষায় আমরা পাই এ ভাস্কর্যটিতে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার অমর বাণীর অবয়বে গড়ে তোলা হয়েছে স্তম্ভটি। ভাস্কর্যটিতে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধকালীন তেজস্বী ভূমিকাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাঙালি জাতির দৃঢ় মনোবল, মুক্তির প্রচণ্ড স্পৃহা, সীমাহীন কষ্ট আর অসীম ত্যাগের বিনিময়ে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখন্ডের। বাঙালি জাতির বীরত্বগাথাঁ ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত 'সাবাশ বাংলাদেশ' তরুণ প্রজন্মকে অকুতোভয় সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে লালন করে গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিতে নীরব রাবি ক্যাম্পাস, সরব পাখিরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মুহিব্বুল্লাহ সৌরভ নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'সাবাশ বাংলাদেশ' ভাস্কর্যটি আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘর। এটাকে যতবার দেখি ততবার দেশের মা ও মাটির জন্য সোনার ছেলেদের আত্মত্যাগের মহান প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়ে যায়। এটি আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার সুযোগ হওয়ার পর থেকে যখনই আমি ভাস্কর্যটির দিকে তাকায় তখনি দেশের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা পায়। এটা শুধু একটি ভাস্কর্য বললে ভুল হবে সার্বিকভাবে এটি আমাদের সাহসের প্রতীক।"

তিনি আরো বলেন, "ভাস্কর্যটির নিচে স্থান পাওয়া সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচিত লাইন দুটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত করে। আমরা বাঙালী। শত্রুর সামনে আমরা মাথা নোয়াবার নই।আমাদের ইতিহাস চির অম্লান।"

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তারিফুজ্জামান বলেন, 'সাবাশ বাংলাদেশ' সম্পর্কে আমাদের জানতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। আমি মনে করি এটিকে যারা কেবল একটি ভাস্কর্য ভেবে থাকেন তারা ভুল করেন। এটি আমাদের গৌরবময় অধ্যয়ের অন্যতম সাক্ষী। এই ভাস্কর্যটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করে তোলো। 

নব-উদ্যোমে নব জাগরণে অনুপ্রাণিত করে। অনেক শিক্ষার্থীরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে বাংলাদেশ মাঠে ঘুরতে আসে, তখন তারা বুঝতে পারে এটা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি। তখন তারা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটা ধারণা পায়। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তোমাদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধো সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলেই তুমি 'সাবাশ বাংলাদেশ' সম্পর্কে জানতে পারবে এবং 'সাবাশ বাংলাদেশ' থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করবে।


সর্বশেষ সংবাদ