জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ হওয়ার পথে অতিথি পাখির আগমন
- জোবায়ের আহমেদ, জাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৩, ০৬:৪৫ PM , আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:০২ PM
হেমন্তের পরে আসে শীত। এ শীতের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে নতুন অতিথি। শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে জাবি ক্যাম্পাসে আসে অতিথি পাখিরা। নিরাপদ বাসস্থানের খোঁজে আসা এই অতিথি পাখিদের কলতানে মুখরিত হয় পুরো ক্যাম্পাস। জাবির সৌন্দর্যের সঙ্গে পাখিদের কোলাহল, প্রকৃতির এ মুগ্ধ রূপ পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসে দর্শনার্থীরা। কিন্তু গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে আশংকাজনক পরিস্থিতির। বিভিন্ন কারণে জাবিতে উদ্বেগজনকভাবে কমছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, সময়মত লেক সংস্কার না করা, কনসার্ট ও আতশবাজির শব্দ, গাছ কাটা, লেক লিজ দেওয়া, বহিরাগতদের উৎপাতসহ নানা অব্যবস্থাপনায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে একেবারের নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে অতিথি পাখির আগমন।
এ ব্যাপারে কথা হয় পাখি গবেষক ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের সাথে। তিনি জানান, ২০২০ সালে অতিথি পাখি আসে ৮১২০-এর মতো। যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ করোনার কারণে তখন ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল এবং কোনো কোলাহল ছিল না। তবে গত বছরও পাখির পরিমাণ কম ছিলো। সাধারণত আমাদের ক্যাম্পাসে চৌরঙ্গীর পাশের লেক, পুরাতন রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন এর পাশের বড় লেক আর ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের পাশের লেকে পাখিদের দেখা যায়।
জলবায়ুর পরিবর্তন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের উৎপাত, কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে প্রবেশ, গাড়ির হর্ণ, কন্সার্ট ও আতশবাজির শব্দ, কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কারণে পাখি বেশিদিন থাকতে পারছে না এবং আসতেছেও কম।
অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, পাখিরা এমন জায়গায় বসতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে যেখানে কোলাহল কম থাকে। কিন্তু ট্রান্সপোর্ট ও চৌরঙ্গীতে মানুষের বেশি কোলাহল থাকায় পাখিগুলো একদম কর্ণারে চলে যায়। আবার কোনসময় তারা উড়ে চলে যায় ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের পাশের লেকটায়। এক সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের লেকটায় অনেক পাখি বসতো। কিন্তু গত ২-৩ বছর ধরে এই লেকটি সংস্কার করা হচ্ছে না বলে সেখানে তেমন পাখি আসে না। পুরো লেকটি কচুরিপানা দিয়ে ভরে গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার প্রধান আব্দুর রহমান বাবুল বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের উৎপাত, কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে প্রবেশ, গাড়ির হর্ণ, কন্সার্ট ও আতশবাজির শব্দ, কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কারণে পাখি বেশিদিন থাকতে পারছে না এবং আসতেছেও কম। কোভিড-১৯ সময়ে ক্যাম্পাসে মানুষজন কম ও পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকায় অনেক পাখি এসেছিল। পাখিবান্ধব ক্যাম্পাস গড়তে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সচেতনমূলক ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।
পাখির বিচারণ, আবাস্থলের নিশ্চয়তা, সংরক্ষণ ও লেক সংস্কার বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ বাজেটে অতিথি পাখি ও লেক নিয়ে আলাদা কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। ক্যাম্পাস উন্নয়ন খাতের মধ্যেই এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতি বছর বর্ষাকালে পলি মাটি, আবর্জনা ও অন্যান্য কারণে লেকগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
আব্দুর রহমান আরও বলেন, ২০১২-১৩ সালে উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনের সময়ে কাবিখার অন্তর্ভুক্ত একটি বরাদ্দ থেকে লেক সংস্কারের জন্য প্রায় ২.৫ কোটি টাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হয়। তখন লেক সংস্কার করা হলেও পরে টাকার অভাবে লেক সংস্কার করা হয়নি। পরবর্তীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জাবি প্রশাসনিক অফিস থেকে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হলেও তা আর পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: শীতেও অতিথি পাখি শূন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এস্টেট শাখার প্রধান আব্দুর রহমান বাবুল জানান, প্রতিবছর অক্টোবর মাসে লেকগুলো পরিষ্কার করতে হয়। এজন্য বাইর থেকে ঘণ্টা বা দিন হিসেবে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নেওয়া হয়। গতবছর অর্থের অভাবে লেকগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।
তিনি আরও জানান, ক্যাম্পাসে নিয়োগকৃত মালি বা পরিচ্ছন্নকর্মী লেক পরিষ্কার ও সংস্করণ কাজ করেন না। অন্যদিকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটা লেক অর্থের বিনিময়ে লিজ দেয়া হয়েছে যেটা লেকে উন্মুক্তভাবে পাখি বিচরণ, খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদিতে বাঁধা সৃষ্টি করেছে।
এস্টেট শাখার প্রধান আব্দুর রহমান বাবুল জানান, যে সব লেকগুলোতে পাখি বিচরণ করে না ওইসব লেক লিজ দেওয়া হয়েছে। লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের পাখি গবেষকদের পরামর্শ ও অনুমতি নেওয়া হয়েছে। তবে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে ক্যাম্পাসের পাখি গবেষক ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান।
অধ্যাপক কামরুল বলেন, লেক লিজের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি বা পরামর্শও নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে, তারাই ঠিক করে দেয় কোন লেকটি লীজ দেওয়া হবে কোনটি দেওয়া হবে না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই কমিটিতে গত ১৫-২০ বছর যাবত প্রাণীবিদ্যা বিভাগের কাউকে রাখা হয়নি।
তিনি বলেন, লিজকৃত লেকগুলোতে পাখি বিচরণে বাঁধা দিচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছে। এতে ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু লেক লীজ নিয়ে থাকলে দেখা যায় মাছের খাবার এর কারণে অনেক বেশি পরিষ্কার করে ফেলে তখন পাখিদের প্রাকৃতিক খাবার আর থাকে না।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান সুদীপ্ত শাহীন বলেন, লিজ দেওয়ার ফলে যারা লিজ নেয় তারা ব্যবসার সুবিধার্থে পানিতে অনেক বিষ, কীটনাশক, কেমিক্যাল মিশিয়ে থাকে। যা পানিতে থাকা পাখি বা কিট পতঙ্গের জন্য ক্ষতিকারক। তবে আমরা এখানে কোন পাখি মারা যাওয়া দেখিনি। পাখিরা এসব লেক ছেড়ে চলে যাওয়া দেখেছি। লেক লিজ দেওয়া পাখিদের বিচরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
বহিরাগত সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাস ক্যাম্পাসে প্রচুর বহিরাগত আসে। ইদানিংকালে আরেক অরাজকতা দেখা গেছে একটা পুরো ফ্যামিলি গেট টু-গেদার করতেছে জাহাঙ্গীরনগরে, যাদের সাথে জাহাঙ্গীরনগরের কোন সম্পৃক্ততা নেই। এটা সাধারণত পার্কে গেলে দেখা যায়। এগুলো আমরা নিরুৎসাহিত করতেছি, বন্ধ করার চেষ্টা করতেছি। মাঝে মধ্যে নিরাপত্তার স্বার্থে বহিরাগতদের প্রবেশ করতে বাঁধা দেওয়া হলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী-কর্মকর্তাদের সহায়তায় তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের মাস্টারপ্লান ঘোষণা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করার জন্য গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। এই ব্যাপারে পাখি গবেষণক ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, প্রতিবছর পরিযায়ী পাখিগুলো নেপাল বা হিমালয় অঞ্চল ও দেশীয় বিভিন্ন হাওর থেকে এই ক্যাম্পাসে এসে থাকে।
তিনি বলেন, হাঁস জাতীয় পাখিগুলো লেকের পাশের গাছগুলোতে বাসা করে থাকে এবং জুন-জুলাইয়ের দিকে গাছে ডিম দেয় ও বাচ্চা ফুটিয়ে বংশবিস্তার করে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অনেক জায়গায় গাছ কাটা পড়ছে যা পাখিদের বাসস্থান ও বংশবিস্তারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর লেকের পাশের গাছগুলো বাচ্চা দেওয়ার মতো ততোটা উপযোগী নয়। এই জায়গাগুলো ছাড়া বাকি যেই জায়গা গুলো রয়েছে; সেগুলো যদি রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, আরো বেশি পরিমাণে গাছ লাগানো যায় তাহলে সবুজের পরিমাণ বাড়বে। তখন ক্যাম্পাস পাখিদের থাকার উপযোগী হবে।
অতিথি পাখি আগে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান করলেও বর্তমানে নভেম্বরের শুরুতে আসে। আর ডিসেম্বর শেষ না হতেই চলে যায়। আগের তুলনায় এখন ৪০% কমে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং বর্তমান কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, সারাবিশ্বে জলবায়ুগত পরিবর্তন হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সাইবেরিয়ার তাপমাত্রা আগের থেকে বেড়েছে হয়তো। যার একটি কারণ হতে পারে পাখি কম আসার। তাছাড়া আগের সময়ের তুলনায় ক্যাম্পাসে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। গাড়ির উচ্চ হর্ণে পাখিরা ভয় পায়। ছুটির দিনগুলোতে বহিরাগতদের অনেকে পাখির দিকে ঢিল ছুড়ে। যার ফলে এখন ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকগুলোতে পাখি বসে না। আবার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অনুষ্ঠানে উচ্চ সাউন্ডে গান, আতশবাজি ফোটানো হয় রাতে। এ কারণে রাতে পাখিদের থাকার পরিবেশ থাকে না।
আরও পড়ুন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখি দেখতে টিকেট লাগবে না: উপাচার্য
পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. খান মাহমুদ মঈম হাসান বলেন, অতিথি পাখি আগে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান করলেও বর্তমানে নভেম্বরের শুরুতে আসে। আর ডিসেম্বর শেষ না হতেই চলে যায়। আগের তুলনায় এখন ৪০% কমে গেছে। পাখি কমার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, কনস্ট্রাকশন সাইটের শব্দ, আবহাওয়ার পরিবর্তন, জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট, বহিরাগত ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের উৎপাত ও পাখি শিকার, গাড়ির উচ্চ হর্ণ, আতশবাজি, মাইকিং, কনসার্টের শব্দ, প্রশাসনের ভূমিকা পালনে অবহেলা ইত্যাদির জন্য পাখি চলে যাচ্ছে।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অন্যতম অংশ অতিথি পাখিদের উদ্বেগজনকভাবে কমে যাওয়ার কারণগুলো অনুসন্ধান করে এ ব্যাপারে দ্রুত ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান পাখি গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পরিবেশবিদরা। [প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া আফরিন, মো. আরিফুল ইসলাম চঞ্চল, সিলভিয়া আক্তার, নাঈম হাসান ও গোলাম আযম]