শিক্ষার্থী নির্যাতনে বেপরোয়া রাবি ছাত্রলীগ, রক্ষা পাচ্ছেন না শিক্ষকরাও

লোগো
লোগো  © ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আচরণ ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। লাগামহীনভাবে চলছে শিক্ষার্থী নির্যাতন, হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শণ, চাঁদাবাজি ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা। শিক্ষার্থীদের শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধরের ঘটনা এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সংগঠনটির নেতাদের এমন আচরণ থেকে বাদ যাচ্ছেন না হল প্রাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।

ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে বিগত ২০২১-২০২২ সালে অন্তত ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও রয়েছে শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬টির। তবে কোনো ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি হয়নি।

শিক্ষার্থীরা বলছেন দুএকটি ঘটনার বিচার হলেও সেটি ছিলো লোক দেখানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে করছেন এসব ঘটনায় শাস্তি না হওয়ায় আবাসিক হলগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যহত হবে।

আরও পড়ুন: রাবি ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ

সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে অত্র হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।

এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে চেয়ার ভাঙচুরের অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ধাওয়া দিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৌমিক ও আতিক নামে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে আটক করে বিভাগের অফিসে নিয়ে আসা হয়।

আরও পড়ুন: ৩০ লাখ চাঁদা না পেয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করল রাবি ছাত্রলীগ

তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রক্টরিয়াল বডির দুইজন সদস্য, মতিহার থানার দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ফোকলোর বিভাগের সভাপতি এবং শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান অপূর্ব জোরপূর্বক তাদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যান।

সংশিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগ শুরুতে আসন দখল করতে আবাসিক হলের কক্ষগুলোয় তালা মারতে শুরু করেন। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে হল থেকে বের করে দেয় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এমন ঘটনাকে ঘিরে হল প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন: রাবি ছাত্রলীগের চার নেতার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা

পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছর উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ১ জুলাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে অবৈধদের বের করে দিয়ে রাতভর বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে তোলা হয়। তুলে দেওয়া ২০ শিক্ষার্থী এখনো হলেই আছেন। এরপর হলের সিট দখলের দৌরাত্ম কমতে থাকে। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার আবারও এমন ঘটনা ঘটল।

রাবি ছাত্রলীগের নির্যাতনের খণ্ডচিত্র
গত ১৯ জানুয়ারি রাত ১১টায় রাবির শাহ মাখদুম হলের ২১৪ নম্বর কক্ষের সামিউল ইসলাম নামের এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে মারধর করে মানিব্যাগ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিলো ওই হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাজবিউল হাসান অপূর্বের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে কাউকে বললে প্রাণনাশের হুমকি দেন ওই নেতা। এ ঘটনায় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।

গত ২২ জানুয়ারি দিবাগত রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বিছানাপত্রসহ মো. জাকির হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীকে নামিয়ে দেয় অত্র হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিন ইসলাম ও তাঁর কর্মীরা। পরে সেই সিটে আরেকজনকে তুলে দেয় মোমিন। বিষয়টি একাধিকবার হল প্রাধ্যক্ষকে জানালেও সমাধান না পেয়ে বিছানাপত্র নিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয় ওই শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন: টাকার বিনিময়ে হলের সিট বিক্রি রাবি ছাত্রলীগের, কথোপকথন ফাঁস

গত বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়।

এরপর মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়ে তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন ক্যাম্পাস ছাড়েন। পরে তিনি গত বছরের ২৬ আগস্ট প্রক্টরের দপ্তরে অভিযোগসংবলিত একটি চিঠি কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠান। আল-আমিনকে গত বছরের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘন্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করা হয়। আল-আমিনের অভিযোগ, নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের দুই নেতা তাঁর ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নেন।

গত বছরের ১৯ আগস্ট মতিহার হলে চাঁদা না দেওয়ায় অর্থনীতি বিভাগের সামছুল ইসলামের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। হলকক্ষে তিন ঘণ্টা আটকে মারধর করা হয় তাঁকে। তাঁকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘কাউকে বললে আবরারের যে অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থা হবে।’

তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিকার নেই হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মারধরের মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও কোনোটির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ওপরের ঘটনাগুলোর দ্রুতই তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু একটিও প্রতিবেদন জমা পড়েনি।

আরও পড়ুন: রাবিতে ভর্তি জালিয়াতি নিয়ে ছাত্রলীগ নেতার অডিও ফাঁস

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, করোনার পর অন্তত ২৩টি ঘটনায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর দপ্তর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সূত্র বলছে, এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সংশিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে একটি ঘটনায়ও ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারিত্ব, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, প্রতীকী অনশনে বসেছেন তিনি। গত বছরের ২৬ জুন তিনি প্রশাসন ভবনের সামনে শামসুজ্জোহা চত্বরে এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ছাত্রলীগের এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিজেরাও ভাবছি। তাদের এমন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে আমরা অসহায় অনুভব করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ছাত্রলীগের এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হতাশাজনক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যার কারণে এগুলো আরও বেপরোয়াভাবে বেড়ে যাচ্ছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলছেন, তাঁরা অনেকগুলো বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। সেগুলো শিগগিরই ডিসিপ্লিন কমিটিতে যাবে। এর মধ্যে অনেকেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে তিনিও মনে করেন, এ ধরনের ঘটনায় শাস্তি হলে হলগুলোতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কমে আসবে।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ হলছাড়া করায় রাবির প্রশাসন ভবনের গেটে অবস্থান শিক্ষার্থীর

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, আমরা এসব বিষয়ে সচেষ্ট আছি। ছাত্র নির্যাতন ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের প্রতিরোধ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। দুএকদিনের মধ্যে এ কমিটির সদস্যরা আলোচনায় বসবেন। এসব ঘটনার প্রতিকার কীভাবে করা যায় এ বিষয়ে সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীই আমাদের কাছে সমান। যদি কোনো শিক্ষার্থী অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে সে যেইহোক তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত অনুযায়ী সত্যতা মিললে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবো।


সর্বশেষ সংবাদ