বাবার কথা চিন্তা করে বিদেশ যাননি, ফরহাদ এখন পুলিশ ক্যাডার
- সিয়াম হাসান
- প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৪, ১১:১৮ AM , আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪, ১১:১৮ AM
৪৩তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সরকার ফরহাদ আহমেদ নির্ঝর। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিদেশে পাড়ি জামাবেন। তবে বাবার কথা চিন্তা করে যাওয়া হয়নি। বিসিএসের চিন্তাও কখনো ছিল না তার। তবে দেরি করে হলেও প্রস্তুতি নেন বিসিএসের। আর নিজের অংশ নেওয়া প্রথম বিসিএসেই পুলিশ ক্যাডার হলেন তিনি।
ফরহাদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলা সদরে। তার বাবা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। মা ছিলেন সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। মা-বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব কেটেছে বিভিন্ন শহরে। তিনি তার মাধ্যমিক ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং উচ্চমাধ্যমিক আনন্দ মোহন কলেজ থেকে পাস করেন।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ফরহাদ। সেখান থেকেই তিনি তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পড়াশোনা শেষে চিন্তা করেন বিদেশে পাড়ি জমাবেন অন্যদের মতো। তবে বাবার কথা চিন্তা করে তা আর হয়ে ওঠেনি। সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দিবেন। শুরু করেন প্রস্তুতি।
প্রস্তুতি শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীন একটি সংস্থার সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল পুলিশ কিংবা পররাষ্ট্রে যাওয়ার। তাই চাকরির পাশাপাশি চালান বিসিএসের প্রস্তুতি। অবশেষে ৪৩তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ফরহাদ। সেখান থেকেই তিনি তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পড়াশোনা শেষে চিন্তা করেন বিদেশে পাড়ি জমাবেন অন্যদের মতো। তবে বাবার কথা চিন্তা করে তা আর হয়ে ওঠেনি। সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস দিবেন। শুরু করেন প্রস্তুতি।
ফরহাদ বলেন, আমার বেড়ে ওঠা ফেলুদা, শার্লক হোমস, টিনটিন আর মিসির আলী পড়ে। ক্রাইম ও গোয়েন্দার প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। মা-বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় বেশ কয়েকটি শহরে থাকা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময় কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানেই জীবনের সবচেয়ে রাঙানো দিনগুলোর স্মৃতি পড়ে আছে। এসএসসি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং এইচএসসি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হই।
তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার তিনটি মাতৃশিক্ষায়তন শত বছরের প্রাচীন এবং দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারী। সবচেয়ে ভালো লাগে যখন দেখি, দেশসেরা ব্যক্তিবর্গের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
ফরহাদের ভাষ্য, ছোট ক্লাসে থাকতে দেখতাম, ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের বড় ভাইরা বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা এবং বিতর্কে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজ, সেন্ট জোসেফ, গভ ল্যাব, ভিকারুন্নেসা, হলিক্রস, রেসিডেনশিয়ালসহ ঢাকার প্রথিতযশা স্কুলগুলোকে হারিয়ে দিয়ে বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। এসএসসি বোর্ড ফলাফলে টপ করছে। স্বপ্ন দেখা শুরু তখন থেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফরহাদ দেখেন, নিজের বিভাগ, হল আর ক্যাম্পাসের সিনিয়ররা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশের নামকে উজ্জ্বল করছে। স্বপ্নগুলো আরো বড় হতে শুরু করল।
বিসিএস দেওয়ার চিন্তা কবে থেকে করেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্নাতক চলাকালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর প্রভাব তার স্নাতক ফলাফলে পড়ে। ঢাবি ক্যাম্পাস জীবন অন্য অনেকের মতো রঙিন কিংবা গোছানো হয়নি। তবে এ নিয়ে দুঃখ নেই তার। সবার জীবনের গল্প এক রকম হয় না।
বিসিএস দেওয়ার চিন্তা কখনোই ছিল না ফরহাদের। তার বিভাগের ট্রেন্ড হলো বেশিরভাগই দেশের বাইরে- বিশেষত নর্থ আমেরিকায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য মাইগ্রেট করে। তিনিও প্রথমে সে চিন্তা করেন জানিয়ে, বাবার কথা ভেবে দেশের বাইরে যাওয়ার চিন্তা থেকে সরে আসে। ভাবতে শুরু করেন কি করা যায়। ততদিনে বন্ধুরা একাধিক বিসিএস দিয়ে ফেলেছে। অন্যান্য সরকারি প্রথম শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। দেরিতে তাদের পথে পা বাড়ান তিনি।
বিসিএসের প্রস্তুতির শুরুতে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বন্ধু নিয়াজ, শিপলুৃ, শাওন, ওহি, আবির ও সৌমিকের কাছে সহযোগিতা পেয়েছেন ফরহাদ। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রস্তুতি শুরুর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন একটি সংস্থার সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হন। ঢাকা সদর দপ্তরে পোস্টিং পান। কাজের পরিবেশ, পদোন্নতি, সামাজিক সম্মান সবদিক থেকে সন্তুষ্টি থাকলেও তার মন পড়ে থাকতো পররাষ্ট্র আর পুলিশ ক্যাডারে। একই সঙ্গে চাকরি এবং বিসিএসের পড়াশোনা চলতে থাকে।
যাদের এ চাকুরি সম্পর্কে ধারণা আছে তারা জানেন- কী পরিমাণ ব্যস্ততা এবং কাজের চাপ রয়েছে এখানে। যেহেতু এর আগে বিসিএস পরীক্ষা দিইনি, তাই চাকরি করে বিসিএস পড়াটা অবিশ্বাস্য রকমের চ্যালেঞ্জিং ছিল। সবচেয়ে কঠিন পর্যায় ছিল, লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি। কারণ এখানে সিলেবাসের ব্যপ্তি বিশাল। যোগ করেন ফরহাদ।
তিনি বলেন, অফিসে একটা কথা প্রচলিত ছিল- এই ডিপার্টমেন্টের এ চেয়ারে বসে কাজ সামলে কেউ কখনো বিসিএসে সফল হতে পারেনি। এ চাকরি করে শূন্য থেকে বিসিএস যাত্রা শুরু করে ক্যাডার হওয়া সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র, পুলিশ বা প্রশাসনের মতো বহুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্যাডার পাওয়া আরো অসম্ভব। অফিসে যে হাতে গোনা কয়েকজন পেরেছেন, তারা যোগদানের আগেই লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন অথবা মূল প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন।
ফরহাদের ভাষ্য, লিখিত পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। ভাইভা নিয়ে তিনি সবসময়ই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। প্রমিত উচ্চারণে বাংলা এবং অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারার দক্ষতা ছিল আমার প্রধান শক্তি। সেই সঙ্গে ছোটবেলা থেকে অ্যাকাডেমিকের বাইরে নানান বিষয়ে বই পড়া, ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি এবং নিয়মিত পত্রিকা, জার্নাল পড়ার অভ্যাস আমাকে ভাইভায় যেকোনো প্রশ্ন মোকাবিলা করার সাহস যুগিয়েছে। আমি মনে করি, বিসিএস ভাইভাতে পুথিগত প্রস্তুতির চেয়ে ম্যানার এবং এটিকেট ডেভেলপ করা বেশি জরুরি। নিজেকে প্রেজেন্টেবল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভাইভা ভালো হয়েছিল।
বিসিএস সফলতায় অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি নামাজে যেটার জন্য দোয়া করতাম, মহান আল্লাহ আমাকে সেই পুলিশ ক্যাডার দিয়েছেন। আমার বাসায় সবার মাঝে ঠিক যেন ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া ইদের আনন্দ ফিরে আসল। প্রাক্তন অফিসে ফোন দিয়ে জানালাম যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছি।
আরো পড়ুন: বাবার পথেই ছেলে, মেহেদী এখন বিসিএস ক্যাডার
ফরহাদের কথায়, এখন থেকে আর কেউ বলতে পারবে না, ডিপার্টমেন্টের এ চেয়ারে বসে, এ কাজ সামলে, কেউ কখনো বিসিএসে সফল হতে পারেনি। আমার যা অর্জন তার পেছনে আমার বাবা, বোন নিশা, ভাগ্নে আরিশ, আর বানু আপার অবদান অনস্বীকার্য। তারা পাশে ছিল বলেই এই অসম্ভব সম্ভবে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, বিসিএস পুলিশ ক্যাডার সার্ভিস বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার গড়ে তোলার সব সুযোগ এখানে আছে। রেগুলার পুলিশিং ছাড়াও, এভিয়েশন উইং, সাইবার স্পেস, স্পেশাল ফোর্স, নারকোটিক্স, ফরেনসিক, এক্সপ্লোসিভসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা যায়। আছে দেশের বাইরে ট্রেনিং, পোস্টিং এবং উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ। জীবনের লক্ষ্য এখন একটাই। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে হবে। যেকোনো ক্যাডার বা নন-ক্যাডারই হোক- এটাই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মূল কথা।