গার্মেন্টসে কাজ করে অনার্স পাস, প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হেলাল

মো. হেলাল উদ্দীন
মো. হেলাল উদ্দীন  © টিডিসি ফটো

প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সচ্ছলতার সঙ্গে শুরু করলেও শিক্ষার বাকি জীবন সেভাবে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি মো. হেলাল উদ্দীনের। নানা বাস্তবতায় আর আর্থিক সংকটে পড়ে একটা পর্যায়ে এসে নিজেই গার্মেন্টসে কাজ করা শুরু করেছেন। একদিকে পড়ালেখা অন্যদিকে কাজ, অদম্য হেলাল পড়ালেখা শেষে কর্মজীবনে পেয়েছেন তার ফলাফল। সম্প্রতি প্রকাশিত ৪১তম বিসিএসের ফলাফলে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। তার মেধাক্রম ছিল ৩৮।

হেলালের বাড়ি পাবনার ফরিদপুর উপজেলায়। স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৩.১৮ সিজিপিএ নিয়ে অনার্স শেষ করেছেন। একই কলেজ থেকে শেষ করেছেন মাস্টার্সও।

অনার্স ফাইনাল ইয়ার থেকে হেলাল বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি ভাবতাম আমাকে দিয়ে কোন জবই হবে না। এইচএসসির পর পারিবারিক সমস্যার কারণে আমাকে গার্মেন্টসের কাজে ঢুকতে হয়। কাজ করার কারণে কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারিনি। শুধু এডওয়ার্ড কলেজে আবেদন করে সেকেন্ড মেরিট থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে যাই।’’

আমি কখনো কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হইনি। শুধু প্রস্তুতি কৌশলগুলো ইন্টারনেট ও পরিচিত কিছু বন্ধু ও শিক্ষকদের থেকে জেনে নিয়েছি। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, বিসিএস না হলে আবার আমাকে গার্মেন্টসে ফিরে যেতে হবে।

পারিবারিক সমস্যার কারণে অর্থ সংকটে হেলাল ভাবতেন কোনো মতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট সেক্টরে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন। সে ধারাবাহিকতায় কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন। অনার্সের পুরো চার বছরে গার্মেন্টসে কাজ করেছেন আর পরীক্ষার সময় আসলে এসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

একবার তিনি অনার্স ৩য় বর্ষ পরীক্ষার সময় পাবনায় এসে বিসিএসের একটি কোচিং সেন্টারের ফ্রি সেমিনারের কথা শুনে মনে হলো তিনি বিসিএস দেবেন। এরপর তার এক বন্ধুর কথামতো নিয়মিত তিনি বিসিএস নিয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্য শুনতেন। এরপর তিনি গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে একটা পর্যায়ে গ্রামে চলে যান। সেখানে গিয়ে মাধ্যমিকের কিছু শিক্ষার্থীকে পড়ানো শুরু করেন। এসব শিক্ষার্থীদের পড়াতে পড়াতেই বিসিএসের মূল প্রস্তুতি শুরু হেলালের।

তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনো কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হইনি। শুধু প্রস্তুতি কৌশলগুলো ইন্টারনেট ও পরিচিত কিছু বন্ধু ও শিক্ষকদের থেকে জেনে নিয়েছি। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, বিসিএস না হলে আবার আমাকে গার্মেন্টসে ফিরে যেতে হবে। সেই ভয়ে রাত জেগে পড়ালেখা করতাম। ৪১তম বিসিএস ছিল আমার প্রথম বিসিএস।’’

বিসিএসে নিজের প্রস্তুতি সম্পর্কে হেলাল বলেন, যেহেতু ৪১তম বিসিএস আমার প্রথম বিসিএস, তাই আগে অনেকের পরামর্শ শুনে নিজের একটা কৌশল ঠিক করি। আমি প্রিলি প্রস্তুতিতে জব সলুশান থেকে বিগত বছরের প্রশ্ন ও সিলেবাস অনুসরণ করে নিজের শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করি।

‘‘আমি বিজ্ঞান, কম্পিউটার, গণিত ও মানসিক দক্ষতাকে শক্তির জায়গা ধরে অন্যান্য বিষয়গুলোতে এভারেজ মার্ক যাতে থাকে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এছাড়া নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতাম। ৩-৪টা প্রকাশনীর মডেল টেস্টের বই ধরে এসব পরীক্ষা দিয়েছি।’’

আরও পড়ুন: থার্টি ফার্স্ট নাইটও থামাতে পারেনি ঢাবির বিসিএস পড়ুয়াদের

বিসিএস লিখিতের প্রস্তুতিতে হেলাল সবচেয়ে বেশি অনুবাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এরপর নবম-দশম ও এইচএসসিতে ম্যাথ-বিজ্ঞানে যা পড়েছেন সেগুলো রিভিশন দিয়েছেন। বিভিন্ন উৎস থেকে কোটেশন কালেক্ট করে নোট করে সেগুলো পড়েছেন। এছাড়া সাহিত্য পড়ার অভ্যাস তাকে লিখিত প্রস্তুতিতে সাহায্য করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক নিয়ে অতিরিক্ত বেগ পেতে হয়নি তাকে।

ভাইভা প্রস্তুতি নিয়ে হেলাল বলেন, ‘‘বিভিন্ন ভাইভা গাইড ও ইন্টারনেট থেকে ভাইভা ভালো করার কৌশল শুনতাম। পত্রিকা পড়তাম এবং নিজের অনার্সে পঠিত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে পড়তাম। ভাইভা বোর্ডে বেশ নার্ভাস ছিলাম। তবে ভাইভা বোর্ড খুবই আন্তরিক হওয়ায় আমার ভাইভা প্রশ্নমূলক না হয়ে ছিল আলোচনামূলক।’’

প্রাথমিক-মাধ্যমিকে ভালো ছাত্র ছিলেন হেলাল। তাই সমাজের দেখানো স্বপ্ন ডাক্তার হওয়াটা ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু অনার্স-মাস্টার্সে এসে যখন পড়ালেখা বন্ধপ্রায় তখন তার কাছে মনে হয়েছে, এই কঠিন জীবন থেকে বের হয়ে বাকি দশজনের মত একটা সম্মানজনক জীবনে ফিরতে পারলেই বাঁচা যায়। সে অনুযায়ী চেষ্টা করেছেন, পেয়েছেন সাফল্যও।

এখনো হেলাল স্বপ্ন দেখেন। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, সমাজের সাধারণ মানুষদের বড় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করা। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে কর্মজীবনে একজন আদর্শ মানুষ হতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ