সফল উদ্যোক্তা
চাকরি খোঁজার বয়সেই চাকরি দিচ্ছেন ইউএপি’র আদর
- হোসাইন আরমান
- প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:০২ PM , আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:১৯ PM
তরুণরা যে কোন দেশের সম্পদ। তবে আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে বেকারের খাতায় নাম লেখান। তারা সম্পদে রূপান্তর না হয়ে প্রকারান্তরে দেশের বোঝা হয়ে যান। এমন সংকটেও অল্প বয়সেই সফল হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএফি) শিক্ষার্থী, তরুণ উদ্যোক্তা প্রকৌশলী মো. আলাউদ্দিন আদর। তিনি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হোম আইডিয়া ইঞ্জিনিয়ার’স অ্যান্ড কনসালটেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও। যেই বয়সে চাকরি খোঁজার কথা সেই বয়সে তিনি চাকরির পেছনে না ছুটে চাকরি দিচ্ছেন। তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় অর্ধ-শতাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী হয়েছে।
তার পথচলা যেভাবে শুরু: গ্রামেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আদরের। ফেনীর শ্যামল ছায়াঘেরা পল্লী সুবল পুরে তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ও বাল্যকালের পুরোটা সময় কেটেছে সেখানে। সুবলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমিকের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন খাইয়ারা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৮ সালে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন ফেনী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ডিপ্লোমা শেষে বিএসসি’র জন্য পছন্দ করেন দেশসেরা পুরকৌশলী, অধ্যাপকদের মিলনায়তন খ্যাত ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। মাধ্যমিকে পড়ার সময় সৃজনশীল কিছু করার তাড়না অনুভব করেন। লেখালেখির পাশাপাশি উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মাথায় জেঁকে বসে। মাধ্যমিকে পড়াশোনার সময়ও পিতার ব্যবসায় সময় দিতেন। পারিবারিক কৃষিতেও পিতাকে সহযোগিতা করতেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার বিরতিতে নিজ গ্রামের অনগ্রসর কিছু ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতেই কোচিং করানো শুরু করেন। তবে সেটা বেশি দিন না করে ফেনী শহরে থিতু হয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন।
অনুকূল পরিবেশ: আলাউদ্দিন আদর যখন ব্যবসায় নামেন তখন পার্শ্ব-পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। ইতোমধ্যে তিনি বাবাকে হারিয়ে বটবৃক্ষের ছায়াহীন হয়ে পড়েন। মা ছিলেন অসুস্থ। তাদের পরিবারের কেউ দেশে তখন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন না। অনভিজ্ঞতা ও নানা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যখন ধুঁকছিলেন; তখন অনেকেই চারপাশ থেকে কটূবাক্য তীরের মতো ছুঁড়তে থাকেন। তাদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য ব্যবসার বিকল্প কিছুই চিন্তা করতে পারলেন না। ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে স্বপ্ন পূরণে ব্যবসাকেই বেছে নিলেন আদর।
উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা: নিজেকে তৈরি করতে পড়াশোনার পাশাপাশি স্বল্প সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। ২০১৫ সালে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তাকে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব দিয়ে একটা চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্টের কাজ দেন। সেই সময় তিনি বলেন, ‘এ প্রজেক্ট করতে গেলে লোকসান হতে পারে কিন্তু পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করলে এটা তোমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।’ তখন তিনি তার বন্ধুর মাধ্যমে লোকবল সংগ্রহ করে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্ধারিত তারিখের আগেই প্রজেক্টের কাজ সু-সম্পন্ন করেন। একটা লোকসানি প্রজেক্টকে বছরের ব্যবধানে লাভজনক প্রজেক্টে রূপান্তর করেন। তখন থেকেই তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তিনি ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন সামনের দিকে।
প্রতিবন্ধকতা জয়: আদরকে কেউ যখন জিজ্ঞেস করতেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি কী করেন?’ তখন তিনি বলতেন, ‘টুকটাক লেখালেখি আর ছোট একটা ব্যবসা করি।’ তখন তারা ব্যাপারটা স্বাভাবিক বা পজিটিভভাবে না নিয়ে আড়চোখে তাকিয়ে বলতেন, ‘বয়স যেহেতু আছে সরকারি চাকুরির জন্য পড়াশোনা করো, এই দেশে ব্যবসা করে কতজন পথে বসেছে।’ উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ না দেওয়া এবং নানাভাবে হেয় করার এমন মানসিকতা অনেক সময় তাকে মাঝে মাঝে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতো। তবে তিনি স্বীয় লক্ষ্য পূরনে অবিচল ছিলেন।
ভালো লাগা: বই পড়তে এবং লিখতে তার খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে সাহিত্য তাকে নেশার মতো টানে। যদিও উদ্যোক্তা হতে গিয়ে সাহিত্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবুও ইতোমধ্যে তার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই স্ব স্ব প্রকাশনীর বিক্রয় তালিকায় শীর্ষে। লেখালেখির জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। নানা ব্যস্ততার ফাঁকে সময় পেলেই পড়তে বসে যান। প্রায়শই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় তার লেখা কবিতা,শিশুতোষ রচনা, রম্য, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি।
কিছু অর্জন: তার লেখা ‘খুশির চাঁদ’ , ‘ফেরার গান’ ও ‘মায়ের ভালোবাসা’ নামের গান তিনটি হয়েছে সমাদৃত ও দর্শক-শ্রোতা নন্দিত।
লেখালেখির পাশাপাশি জড়িত আছেন তরুণদের নিয়ে তার ‘এসো শিখি’ নামে একটি টিম। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নে কাজ করেছেন সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন; বর্তমানে তিনি সংগঠনটির সভাপতি। কাজ করেছেন পথের ফুল, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশী ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে।
সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেছেন প্রিয় বাংলা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০১৮, পথিক লেখক সম্মাননা-২০১৬ এবং একুশে বইমেলা বুলেটিন-২০১৬ লেখক সম্মাননা স্মারকসহ নানান পুরস্কার ও সম্মাননা। নানামুখী প্রতিভাবান এই তরুণের ঝুলিতে রয়েছে ঢাকা থেকে প্রকাশিত নয়াচাবুক নামক কার্টুন পত্রিকার আইডিয়া কার্টুন প্রতিযোগীতায় তিন বার দেশসেরা কার্টুনিস্ট হওয়ার গৌরব।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে, আগামীর বাংলাদেশ তরুণ উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল। তাই দেশ ও জাতির উন্নয়নে তার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। পাশাপাশি তিনি আরও কিছু উদ্যোগের সাথে জড়িত। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কো-ফাউন্ডার তিনি। আদর সব সময়ই আশাবাদী। তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাসী তিনি। বর্তমানে তার নানা প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু সংখ্যক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও অসংখ্য শ্রমিক কাজ করছেন নানান প্রকল্পে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, ২০২৬ সাল নাগাদ তার কোম্পানিতে অসংখ্য প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, হাজার হাজার শ্রমিকের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
বছর খানেকের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কিছু উদ্যোক্তা বন্ধুর সহায়তায় তিনি প্রায় অর্ধশত চাকরি চাকরী প্রার্থীকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশকিছু প্রজেক্টের কাজ চলছে; সে প্রজেক্টগুলো প্রতিশ্রুতি অনুসারে যথাসময়ে হস্তান্তর করার জন্য কাজ করছি। আমরা কেবল দেশ নয়, একদিন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করবো, ইনশাআল্লাহ।