বাজেটের ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রীর কালো ব্রিফকেসে কী থাকে?

বাজেটে অধিবেশনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী
বাজেটে অধিবেশনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী   © সংগৃহীত

বাজেট কথাটি আলোচনায় এলে আমাদের কল্পনায় যে চিত্রটি প্রথম আসে সেটি হচ্ছে- অর্থমন্ত্রী পরিপাটি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি কালো ব্রিফকেস হাতে সংসদ অধিবেশন কক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আসলে কী থাকে এ কালো ব্রিফকেসে? কীইবা এর মাহাত্ম্য?

কালো ব্রিফকেসের মাহাত্ম্য জানতে হলে চলে যেতে হবে বাজেট শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে। ফরাসি শব্দ বোওগেট থেকে বাজেট শব্দটি এসেছে। যার বাংলা অর্থ চামড়ার ব্যাগ। স্যার রবার্ট ওয়ালপোল ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেন ১৭২০ সালে।

এর ঠিক ১৩ বছর পর ওয়ালপোল সরকারের করের বোঝা কমাতে তার রাজস্ব পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর আবগারি শুল্ক ধার্য করার প্রস্তাব করেন। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন করেন।

এরপরই উইগ পিয়ার উইলিয়াম ‘দ্য বাজেট ওপেন অর অ্যান আনসার টু এ প্যামফলেট’ শিরোনামের একটি পুস্তিকা লেখেন। সেবারই সরকারের রাজস্বনীতিতে ‘বাজেট’ শব্দটি প্রথমবারের মতো ব্যবহার হয়েছে। তবে, বাজেটের আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৭৬০ সালে।

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতা দেন জেমস উইলসন এবং ১৮৬০-৬১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। দিনটি ছিল ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল, কলকাতায়।

আরও পড়ুন: ‘আমাদের আনন্দ এখন ফেসবুক লাইকে, পাখি-প্রকৃতি দেখে না’

এই উপমহাদেশে উইলসনই প্রথম গণতান্ত্রিক ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপের সরকার পদ্ধতির আওতায় সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার বাজেট পেশ করেন, যা আজও বিদ্যমান বাংলাদেশ এবং ভারতে।

ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ববাংলা প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। জানা যায়, হামিদুল হক চৌধুরী সে অধিবেশনেই ১৯৪৮-৪৯ সালের বাজেট পেশ করেন। সেবারও ‘ব্রিফকেস রীতি’ মানা হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। একইসঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। তখনও তার হাতে ছিল ‘বাজেট ব্রিফকেস’।

প্রথা অনুযায়ী ‘লাল ব্রিফকেস’ হাতে নিয়ে বাজেট পেশকারী সংসদে প্রবেশের আগে চিত্রসাংবাদিকদের সামনে এসে ছবি তোলেন। দেখা গিয়েছে, এই রহস্যময় ব্রিফকেসের রঙ সবসময় লাল ছিল না, তা বছর বছর বদলেছে। কখনও কালো আবার কয়েক বছর মেরুন রঙেরও দেখা গেছে। কিন্তু এই ব্রিফকেসকেই কেন বাজেটের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়? আগেই বলেছি, বাজেট মানে চামড়ার ব্যাগ।

রীতি অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী এই বাজেট ব্রিফকেস বহন করে নিয়ে আসেন। এর ভেতরে থাকে বাজেট সম্পর্কিত বিভিন্ন ফাইল ও কাগজপত্র। সবচেয়ে বেশি বাজেট পেশকারী সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এম সাইফুর রহমানকেও এই ব্রিফকেস নিয়ে আসতে দেখা গেছে।

এরমধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যবহার করেছেন মেরুন ও কালো রঙের ব্রিফকেস। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটেও তিনি ব্রিফকেস নিয়ে সংসদের প্রবেশ করেন।

বাজেট ব্রিফকেস’র এই রীতি শুরু হয়েছিল ১৮ দশক থেকে। ব্রিটেনের বাজেট প্রধানকে এই ব্রিফকেস খুলে বাজেট বলতে বলা হত। ১৮৬০ সালে ব্রিটেনের বাজেট প্রধান উইলিয়াম ই গ্ল্যাডস্টোন লাল স্যুটকেসে করে বাজেট সংক্রান্ত নথি নিয়ে আসেন। সেই স্যুটকেসের ওপর সোনা দিয়ে রানির ছাপ দেয়া ছিল। তিনি পরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ওই একই ব্যাগ এরপর বহু সরকারের আমলেই ব্যবহার করা হয়েছে।
 
একটা সময় ছিল, অনেক দেশে বাজেটের আগের সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কর্মকর্তাদের একটি হোটেল কক্ষে প্রায় বন্দি অবস্থায় রাখা হতো। তাদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। হোটেল কক্ষেই তারা বাজেট গঠন করতেন ও সংসদে উত্থাপনের পরে বাড়ি ফিরতে পারতেন।

তবে এখন সময় বদলে গেছে। নানামুখী স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেটে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা হয়। বাজেটের আগে দফায় দফায় অনুষ্ঠিত হয় নানামুখী আলোচনা সভা। এরপরে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা আলোচনা শেষে প্রস্তুত করেন পুরো অর্থবছরের বাজেট। আর সেই বাজেট কালো ব্রিফকেসে পুরে অর্থমন্ত্রী প্রবেশ করেন সংসদে, উত্থাপন করেন বাজেট।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে আগামী ৯ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করবেন। ইতোমধ্যে গত ৫ জুন থেকে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করবেন। অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, বৈশ্বিক সংকটের দিকে নজর রেখে নতুন বাজেটে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও থাকবে।