ডাকসু নির্বাচন
বদলে যাচ্ছে ছাত্র রাজনীতির মানচিত্র!
- শিউলী রহমান
- প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০১৯, ১২:৩৩ AM , আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৯, ০২:৩৮ AM
বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেল। অনিয়ম, কারচুপি, নিয়ন্ত্রণ, মারধর, হামলা, মিছিল, বিক্ষোভ, ধাওয়া, অবরোধ, প্রত্যাখান, বর্জন, গভীর রাতে ফল ঘোষণা, উচ্ছ্বাস ও উৎকন্ঠা- কী নেই এ নির্বাচনে। ২৮ বছর পর গত সোমবার অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ২৫টি পদের মধ্যে জিএস, এজিএসসহ ২৩টি পদে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ছাত্রলীগ। নির্বাচনে জয় পায়নি বিএনপির সংগঠন ছাত্রদল ও বাম সংগঠনের কোন প্রার্থী। ডাকসুর সবচেয়ে বড় আসন ভিপি পদে জয় পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরুল হক নুর। আর সমাজ সেবা সম্পাদক পদে জয় পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে একা অনশনকারী আইন বিভাগের ছাত্র আখতার হোসেন।
সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতা এবং শিক্ষা আন্দোলন বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনে একদিকে যেমন ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য অক্ষুন্ন রাখার জন্য সব প্রচেষ্টা ছিল, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচনের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। ছেলেদের ১৩টি হল ছাত্রলীগ অপেক্ষাকৃত বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও মেয়েদের ৫টি হলে তা পারেনি। অনিয়ম-কারচুপির প্রতিবাদ, ভোট পাহারা এবং ধৈর্য্য ধরে লাইনে দাড়িয়ে থেকে ভোট প্রদানে ছাত্রীরা ছিল সরব ও সক্রিয়। সব মিলিয়ে এ নির্বাচন যেমনি শতভাগ পরিচ্ছন্ন হয়নি, তেমনি শতভাগ জালিয়াতিপূর্ণও হয়নি। শিক্ষার্থীদের নীরব সমর্থন এবং ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বিস্তার চলেছে একইসাথে। এ পর্যায়ে আঞ্চলিক রাজনীতির হিসেব এবং ক্যাম্পাস শান্ত রাখতে কর্তৃপক্ষের কৌশলের কারণে ছাত্রদের সহানুভূতি পাওয়া নুর ও আখতার উতরে গেছেন।
রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকরা বলছেন, ছাত্র অধিকার নিয়ে আন্তরিক কথা বলা এবং সক্রিয় ও প্রচেষ্টারত থাকার বিষয়টি দেশের দলীয় বৃত্তে বন্দি ছাত্র সংগঠনগুলো ভুলে গেছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নেতাদের কাছে তাদের অধিকার আদায়ের কথা শুনতে চায়, কাজ দেখতে চায়। যার প্রতিফলন ঘটেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ে এবং ছাত্রদল ও বাম প্রার্থীদের পরাজয়ে। আর নিয়ন্ত্রণের কারণে ও প্রার্থী বাছাইয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ছাত্রলীগ। আগামী দিনগুলোতে এ দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষা আন্দোলনের মানচিত্রে ধীরে হলেও বড় পরিবর্তন আসবে। ডাকসুর পর অন্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হবে। সেখানেও কমবেশি একই ধারায় নির্বাচন প্রক্রিয়া, ফলাফল ও পরিবর্তন আসতে পারে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর এবার অষ্টমবারের মত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে কখনও ডাকসুতে ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন জয় পায়নি। এবার দুইটি পদ বাদে ২৩টিতে জয় পেয়েছে ছাত্রলীগ। এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাত্রলীগের আধিপত্যেরই পরিচায়ক। আবার ১৮টি হলের মধ্যে ১২টিতে ভিপি পদে জয়ী ছাত্রলীগ। বাকি ছয়টিতে স্বতন্ত্র। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এবং প্রশ্নফাঁস বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ছাত্রলীগ আরো কম পদ এবং ছাত্রদের দাবির পক্ষে সরব প্রার্থীরা আরো বেশি পদে বিজয়ী হতো। বর্তমান ফলটি মূলত: নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ফল। যেমন শামসুন্নাহার হলে ভোটের আগের দিন থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত ছাত্রদল, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষন পরিষদ ও বাম সংগঠনগুলোর নেত্রীরা ভোটকেন্দ্র ও ব্যালট পাহারা দিয়েছেন। এমনকি হলের প্রভোস্টের কক্ষে নিয়ে ব্যালট পেপার গুনতে দেননি তারা। এ হল সংসদের ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ১৩টি পদের আটটিতে জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অন্যদিকে বাকি ৫টিতে জয় পায় ছাত্রলীগ। অন্যদিকে অনিয়ম-কারচুপির প্রতিবাদে রোকেয়া হলে দুই দফা ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। পরে বিকাল তিনটা থেকে সোয়া ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হলেও তখন আর অনাবাসিক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে ভোট দেয়ার লাইনে দাড়ায়নি। এ হলে ছাত্রলীগের পুরো প্যানেল জয় পেয়েছে। আবার কুয়েত-মৈত্রী হলে সিলসহ ব্যালট উদ্ধারের পর ভোটগ্রহণ স্থগিত ছিল তিন ঘন্টার বেশি সময়। পরে বর্ধিত সময়ে লাইন ধরেই ভোট দিয়েছেন তারা। পরে ফলাফলে দেখা যায়, এই হলের ১৩টি পদের সবগুলোতেই জয় পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ তিন হলের উদাহরণ টেনে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হলে ফলাফল কেমন হত তার মাপকাঠি হতে পারে এ দুই হলের ফলাফল।
এদিকে সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির প্রতিবাদে ভোট বর্জন করে মঙ্গলবার থেকে ধর্মঘট আহবান করেছিল ছাত্রদল, বাম জোট, সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা। এ সম্মিলিত বিক্ষোভ বড় আকারে দানা বাঁধার আগে ক্ষমতাসানীরা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগকে মাঠে রাখার কৌশল নিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে দিয়ে মাঠ গরম রেখে অন্যদেরকে মাঠ ছাড়া করা একটি কৌশল হতে পারে। পাশাপাশি ২৫ সদস্যের ডাকসুতে সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতাকে শুরু থেকেই চাপে রাখতে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন। এটি ছাত্রলীগের দ্বৈত চরিত্রের বহি:প্রকাশ।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ও ব্যাকফুটে থাকা ছাত্রদলকে আরো পেছনে ফেলে দিচ্ছে বিদ্যমান পরিস্থিতি। ক্যাম্পাসে না থাকায় বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের বোঝাপড়ার সমস্যা হয়েছে। প্রচারণার সময় ছাড়া তারা ক্যাম্পাসে অবস্থান-বিচরন করতে না পারায় নিজেদের বক্তব্যও তুলে ধরতে পারেনি। সংগঠনটির অপেক্ষাকৃত বয়স্ক নেতৃত্বও এ পিছিয়ে পড়ার কারণ। আর ছাত্রলীগ, বাম ও কোটার নেতারা এক্ষেত্রে সংযোগের ধারবাহিকতাই রক্ষা করেছে।
ছাত্রলীগের এক নেতা জানান, ছাত্রলীগে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের গ্রুপিং দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয়। সংগঠনটির ভিপি প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরি শোভনের বাড়ি উত্তরবঙ্গে। গ্রুপিং রাজনীতিতে শোভনের নাম কেটে গেছে। তবে ছাত্রলীগেরই আরেকটি অংশ বলছে, কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার আগে শোভন মাদক সেবনের দায়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন বলে কিছু নিউজ কাটিং অনেকের ফেসবুক ইনবক্সে ঘুরে। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী নেতাকর্মীদের সাথে যতটা মিশতে পারেন ততটা পারেন না শোভন। তাই অনেক কর্মী জিএস পদে রাব্বানী ও এজিএস পদে সাদ্দামকে ভোট দিলেও ভিপি পদে শোভনকে দেয়নি। অন্যদিকে নুর সহানুভূতি ভোট পেয়ে গেছে।
নির্বাচন পরিস্থিতি ও ফল পর্যালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহাবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কতটুকু হয়েছে তা আরো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণসাপেক্ষ। তবে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত শক্তি যে এখনও বড় প্রতিরোধ গড়ে তোলে এ নির্বাচন সে বার্তা পুনরায় দিয়ে গেল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সব মহলেই আগ্রহ, উৎসাহ ও অপেক্ষা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের দিন যে নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও অনিয়মের চিত্র দেখা গেল তা এখন উল্টো বার্তা দেবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রশাসনকে আরো প্রস্তুত, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দেয়ার দরকার ছিল। এখন দেখার বিষয় এ নির্বাচন সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিসর আরো সংকুচিত করে নাকি কিছুটা উন্মুক্ত ও উদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। যদিও সে ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এত বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল যা আরো ভালোভাবে মোকাবেলা করা যেত। কিন্তু সবমিলিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। তিনি সব পক্ষকে নির্বাচনের ফল মেনে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়তার জন্য আহবান জানিয়েছেন।