১৫ বছরে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে ৩৯ খুন

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার কয়েকজন
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার কয়েকজন  © সংগৃহীত

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী পিটিয়ে হত্যা করে। সে ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েটসহ পুরো দেশ। এরপর ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি। ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এটিই প্রথম নয়।

ক্ষমতায় থাকা পুরো সময়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। ফলে গণমাধ্যমের বারবার শিরোনাম হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। শুধু সাধারণ শিক্ষার্থী নয় সাধারণ মানুষ যেমন হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তেমনি নিজ দলের অনেক নেতাকর্মীও রয়েছেন।

গত এক দশকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ একাই খুন করেছে অন্তত ৩৯ জনকে। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় পত্রিকা ও গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।

বুয়েটে আবরার হত্যা
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর দুইদিন আগে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার ফাহাদ রাব্বী। এর জেরে পরদিন ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী।

তারা আবরারের ১০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে রাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইলসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। এরপর ওই কক্ষে আবরারকে নির্যাতন করা হয়। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর হত্যাকাণ্ড
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্মমভাবে খুন হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর। এ ঘটনায় ঢাবির আইন বিভাগের ছাত্র আহত ওমর ফারুক শাহবাগ থানায় ১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করেন। প্রায় আট বছর চলে মামলা। বাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন সরকারি কৌঁসুলি।

২২ সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০১৭ সালের ৭ মে বাদী ও আবু বকরের পরিবারের অজান্তে মামলার রায়ে ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। রায়ে আবু বকরের হত্যায় কে দায়ী, তা নিশ্চিত হয়নি।  

জাবিতে জুবায়ের হত্যা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) এ হত্যাকাণ্ডের জন্যেও ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কলহের জেরে এক হামলায় গুরতর আহত হন জাবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পাসে তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

চবিতে ৮ হত্যাকাণ্ড
২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের ষোল শহর রেলস্টেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন কায়সারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে তাকে নিজেদের কর্মী দাবি করে ছাত্রলীগ ও শিবির হত্যার জন্য একে অপরকে দায়ী করে।

এর প্রায় দেড় মাস পর ২৮ মার্চ রাতে শাটল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদকে গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নগরীর চৌধুরীহাট এলাকায়। একই বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে অ্যাকাউন্টিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান নিহত হন।

২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে দফায় দফায় গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় মুজাহিদ ও মাসুদ বিন হাবিব নামে শিবিরের দুই নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। মাসুদ সোহরাওয়ার্দী হলের শিবির সেক্রেটারি ছিলেন।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শাহ আমানত হল ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন নিহত হন। ২০১৪ সালে ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ কর্মী তাপস।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ। পরে ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরি বাদী হয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক ১০ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দিয়াজ গ্রুপের প্রধান দিয়াজ ইরফান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারের বলি হয়েছেন!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হত্যাকাণ্ড
২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। পরের বছর ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবির-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কর্মী ও গণিত বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন।

একই বছর ১৫ আগস্ট শোক দিবসে টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ নাসিমকে ফেলে হত্যা করে ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা।

২০১২ সালের ১৫ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল। পদ্মা সেতুর চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের এই আভ্যন্তরীণ কোন্দল লাগে বলে রিপোর্টে প্রকাশ।

ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ। ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা
এ হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও প্রকাশের পর সারা দেশ প্রকম্পিত হয়। শিবির সন্দেহে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির দিনে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু রাব্বিসহ ২ হত্যা
কোনো শিক্ষার্থী নয় বাকৃবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বলি হন  ১০ বছরের শিশু রাব্বি। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।

২০১৪ সালের ৩১ মার্চ নিজ দলের নেতাকর্মী হাতেই প্রাণ হারান আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সায়াদ ইবনে মমাজ। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে সে সময় জাতীয় সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ খুন
২০১২ সালের ৯ জুন সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ফাহিম মাহফুজ বিপুল। ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা পড়েন হাবিপ্রবির বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাকারিয়া ও কৃষি বিভাগের ছাত্র মাহমুদুল হাসান মিল্টন।

রুয়েট ও যবিপ্রবিতে দুই হত্যাকাণ্ড
২০১২ সালের ১২ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল আজিজ খান সজীব খুন হন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলামকে। ঘটনায় জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ হত্যার বিচার তো দূরের কথা, অভিযোগপত্রই তৈরি করতে পারেনি পুলিশ।

শাবিপ্রবি ও এমসি কলেজে দুই খুন
হল দখলকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ হয়। এতে নিহত হন বহিরাগত ছাত্রলীগ কর্মী সুমন চন্দ্র দাস। তিনি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন।

২০১০ সালের ১২ জুলাই এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ টিলাগড়ে খুন হন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন তার বাবা বীরেশ্বর সিংহ। বিচার শেষ হয়নি এখনও।

ঢামেকে এক হত্যাকাণ্ড
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংঘর্ষে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ওই বছরের ৩০ মার্চ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় কলেজ। কিন্তু ওই ঘটনারও কোনো সুরাহা হয়নি।

ঢাকা কলেজে দুই হত্যাকাণ্ড
২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল ইফতারের টেবিল বসানো নিয়ে নিউ মার্কেটের দুই দোকানের কর্মীদের বচসার পর এক পক্ষ ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মীকে ডেকে আনে। তারা গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার পর ছাত্রাবাসে ফিরে আরও শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসে দোকানকর্মীদের উপর হামলা চালাতে গেলে বাঁধে সংঘর্ষ। এসময় এলিফ্যান্ট রোডের একটি কম্পিউটার এক্সেসরিজের দোকানের ডেলিভারিম্যান নাহিদ সংঘর্ষে আহত হয়ে সে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ নেতা জুলফিকার, ফিরোজ ও জসিম।

২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতি ফুয়াদ হাসান ও সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসানের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে গুলি-বোমা ছুড়ে কলেজে আতঙ্ক ছড়ায়। এ সময় কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আসাদুজ্জামান ফারুকসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান ফারুক।

কুবিতে ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ড
২০১৬ সালের ১ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের অন্তর্কোন্দলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ।

২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর আবিদুর রহমানকে দফায় দফায় পিটিয়ে গুরুতর ভাবে আহত করে। পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবিদুর রহমান মারা যান। আবিদুর হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগের ক্যাডারদের দায়ী করে অবিলম্বে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।

আবরার ফাহাদের মতো পরিণতি চমেক শিক্ষার্থী আবিদের
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর পিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আবিদুর রহমান আবিদ। তিনি ছিলেন চমেকের ৫১তম ব্যাচের ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী।

স্বজনদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টা করায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা কয়েক দফা পিটিয়েছিলেন আবিদকে। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোনের বাসায়। দুইদিন পর ২১ অক্টোবর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ। তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মধ্যম বড়ইতলী গ্রামের মৃত নুরুল কবির চৌধুরীর ছেলে।

এ ঘটনায় আবিদের মামা নেয়ামত উল্লাহ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের ২২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

মাভাবিপ্রবিতে মোশাররফ হত্যাকাণ্ড
টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) ২০১৫ সালের ১৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ নামধারী দুই গ্রুপ মোশাররফ ও মনিরুল ইসলাম মনির গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মনির গ্রুপের লোকজন এ এস কে মোশাররফ ও তার অপর দুই সমর্থক ছাত্রকে কুপিয়ে ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে।

আহত মোশারফকে প্রথমে টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ড. গৌতম ঘোষ তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। নিহত মোশাররফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ তত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তগাছা উপজেলার মুজাটি চরপাড়া গ্রামে।

রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রমৈত্রী নেতা সানি হত্যাকাণ্ড
২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রী নেতা রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে সানিকে কুপিয়ে জখম করে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা। পরে ওই দিন বিকেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হামলায় আহত হন পলিটেকনিক শাখার ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি কাজী মোতালেব জুয়েলসহ আরও কয়েকজন নেতা। 

সিলেটে আরও ২ খুন
২০১৭ সালের ১৭ জুলাই সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে শ্রেণিকক্ষের ভেতর খুন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল গ্রুপের কর্মী খালেদ আহমদ লিটু। তাকে গুলি করে খুন করা হয়। এ ঘটনায় তার বাবা ফয়জুর রহমান ছাত্রলীগের ফাহাদ আহমদসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

সিলেটের মদন মোহন কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট ছুরিকাঘাতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল আলী। মদন মোহন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন বিধান সাহা গ্রুপের কর্মী আলী। 

যশোরের এমএম কলেজের কামরুল ও হাবিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড
২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর। দিনের বেলা প্রকাশ্যে ধরে এনে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ছাত্র মো. কামরুল হাসান ও মো. হাবিবুল্লাহ হোসাইন হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় যুক্ত ছিল সম্প্রতি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। এ ঘটনা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ না হওয়ায় ‘অভিযুক্ত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি’ পুলিশ।

আরো পড়ুন: সাতক্ষীরায় ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত

বিভিন্ন কলেজে আরও দুই খুন 
২০১৪ সালের ৪ জুন ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাওহীদুল ইসলামকে। তাওহীদ এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কলেজ শাখার আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সামসুর রহমানের ছেলে।

ওই ঘটনায় পরদিন তাওহীদের চাচা আনোয়ার হোসেন মাতবর বাদী হয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুলসহ ছাত্রলীগের ১৬ নেতা-কর্মীকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্তকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে যুবলীগ কর্মীরা। নিহত শান্ত পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে ঈশ্বরদী হাসপাতালের সামনে পৌঁছুলে যুবলীগকর্মী রুবেল ও আল-আমিনসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী তাকে কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। এরপর তাকে ঈশ্বরদী হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান তিনি।

আরো পড়ুন: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত খালিদের শরীরে ৭০ গুলির ফুটো

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, তবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িততে বিচার করতে হবে
২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ও সাহসী বলে মনে করছে ছাত্রনেতারা। তবে বিগত সময়ে ছাত্রলীগের হয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে তারা।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ছাত্রলীগ একটি খুনি সংগঠন। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি থেকে শুরু করে গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ছাত্রলীগ। সবগুলো জঙ্গি সংগঠন মিলে যত মানুষ খুন করেছে ছাত্রলীগ এককভাবে তার চেয়ে বেশি মানুষ খুন করেছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ছাত্রদল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এতে ছাত্রলীগ এবং সরকারি বাহিনীর হাতে ছাত্রদলের শতাধিক নেতাকর্মী গুমের শিকার হয়েছে এবং শহীদ হয়েছে। 

ছাত্রদলের এ নেতা আরো বলেন, ছাত্রলীগ ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পেতে  যখন বিভিন্ন মহল থেকে  বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল, তখন ছাত্রদল শুধু সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি করেছিল। আজ ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ছাত্ররাজনীতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।

গণতন্ত্রকামী সব ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে  গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার পথ উন্মুক্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা চূড়ান্ত সমাধান নয়। ছাত্রলীগের হয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম বলেন, খুনি সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম একটি অর্জন। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তা একটি যৌক্তিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত। 

‘আমরা দেখে আসছি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিমে ছাত্রলীগ কী রকম ভয়ানক রূপ ধারণ করেছিল। ভয়, ত্রাস, সন্ত্রাস, হত্যা আর ছাত্রলীগ সমার্থক। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাস দখল, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনসহ অপরাধের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তাদের বিচরণ ছিল না’, যোগ করেন তিনি।

ছাত্রশিবিরের এ নেতা বলেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে শহীদ নোমানী, আবু বকর, বিশ্বজিৎ, আবরারকে কি ভয়ানকভাবে শহীদ করেছে ছাত্রলীগ। সর্বশেষ চব্বিশের বিপ্লবে শতসহস্র ভাই-বোনকে পৈশাচিকভাবে রক্তাক্ত করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো অধ্যায়। জুলাইয়ে শহীদ হওয়া নাসিমা, তরুয়া, ওয়াসীম, আবু সাঈদ, আলী রায়হান, মুগ্ধ, শান্তরা আমাদের চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো অন্তিম ঠিকানায়! 

‘তাদের দলীয়ভাবে এহেন পাশবিক হত্যাযজ্ঞ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না বরং তার ধারাবাহিকতার মাত্রা বছরের পর বছর আরো বর্বরোচিত হচ্ছিল। এখনো তারা বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে পাঁয়তারা করছে। গুপ্ত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে অনেক জায়গায়। ছাত্রলীগ কেন নিষিদ্ধ করা হলো তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জরুরতও দেখি না। পুরো দেশের আকাঙ্ক্ষারই এখানে বাস্তবায়ন ঘটেছে।’

সাদিক বলেন, শুধু নিষিদ্ধ নয়, যারা খুন, ধর্ষণ, গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত ছিল ও সমর্থন দিয়ে গেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। পরবর্তীতে যেন দেশকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে সেদিকে ছাত্রজনতা ও সরকারের  সচেতন দৃষ্টিই জাতির একান্ত প্রত্যাশা।


সর্বশেষ সংবাদ