মিলন স্মৃতি পাঠাগার ও একজন আতিফের গল্প
- আল-আমিন মাসুদ
- প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৫২ AM , আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ১২:২১ PM
পুরো নাম শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদ। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। দিনমজুরের ছেলে আতিফের ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ঝোঁক। তবে পারিবারিক দৈন্যতায় সেই সুযোগ তেমন একটা হয়নি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়াটা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল।
তবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের পড়তে না পারার বিষয়টি তাকে দারুন পোড়ায়, সাথে মাথায় আসে তারই মত গ্রামের অন্য তরুনদের কথা। তাদেরও তো জ্ঞান অর্জন করা দরকার। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সেই ভাবনা থেকেই আতিফের লাইব্রেরী করার চিন্তা। বড় ভাইকে সাথে নিয়ে শুরু করে দিলেন লাইব্রেরি করার কাজ।
সাইকেলে করে সবাইকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেন। আবার সপ্তাহ শেষে নিয়েও আসেন। সম্পূর্ণ কাজটিই করেন বিনামূল্যে। অনার্সের পড়ার পাশাপাশি এখন একাই এই কাজ করে যাচ্ছেন আতিফ।
নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও জ্ঞানের আলোর ছড়ানোর এই চিন্তা কিভাবে আসলো জানলে চাইল আতিফ জানান, `আমি টাকার অভাবে ঠিকভাবে স্কুলে যেতে পারতাম না। যেহেতু টাকার অভাব, তাই মাঝে মাঝে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রির কাজ, খাট বার্নিশ, ধান কাটতাম। করতাম আর লেখা পড়া চালাতাম।’
তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিলো লেখাপড়া করবোই। তাই স্কুল বন্ধ দিলে বা সমস্যার সম্মুখীন হলে কাজ করে খরচ চালাতাম। এই রকম কষ্টগুলো আমার খুব বিবেকে নাড়া দিতো। তাই ভেবেছিলাম, গ্রামের জন্য কিছু একটা করবো। সেই থেকে ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে বাড়ীতেই শুরু করলাম পাঠাগার। যেহেতু টাকা নেই, ঘর ভাড়া করে শুরু করা আমার পক্ষ সম্ভব না তাই বাড়ীতেই শুরু করলাম।’
আতিফ বলেন, ‘এরপর জমিজমার বিরোধে প্রভাবশালীদের হাতে বড় ভাইকে খুন করা হলে তার নামেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। ভাই যেহেতু শুরু থেকেই সাথে ছিলো, সবসময় অনুপ্রেরণা দিতো উৎসাহ যোগাতো, তাই তার নামেই মিলন স্মৃতি পাঠাগার শুরু করলাম।’
প্রাথমিকভাবে শুরু করতে অনেক সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে বারান্দায় পাট শোলা দিয়ে একটা ছোট্র রুম করে ২০টা বই দিয়ে সেখান থেকেই শুরু করলাম। আমি বিশ্বাস করতাম, ভালো কাজ যেহেতু অবশ্যই বই দিয়ে সবাই সহযোগিতা করবে। তারপর আস্তে আস্তে বই আসা শুরু করলো। বই রাখার মতো কোন অবস্থা ছিলো না। বাড়ীতে কাঠ ছিলো সেগুলো দিয়ে বাবাকে সাথে নিয়ে একটা ভাঙ্গা সেল্ফ বানালাম।’
একসময় লাইব্রেরীর কথা শুনে গ্যাসটন ব্যাটারীজ লিমিটেড-এর নির্বাহী পরিচালক কে এইচ মালেক সাহেব বাংলা সাহিত্যেরর সেরা ১০০ বই দিলেন। এভাবে আস্তে আস্তে সবাই বই দিতে থাকলে, ৫০০ বই হয়ে গেলো। এখন রাখার সমস্যা। পরে স্যার আবার একটা আলমারি কিনে দিলো। ভিয়েতনামে বাংলাদেশ এর রাষ্ট্রদূত বই কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠালেন।
যখন শুরু করলাম, তখন এলাকার মানুষ টিটকারি দিতো। চুপিচুপি বলতো, এই সময় ভালো করে লেখাপড়া না করে বই বিলিয়ে বেড়ায়। খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। আমি তাদের কথা কখনো শুনতাম না। আমি জানি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সবার টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য নেই। যেখানে লেখাপড়ার খরচই যোগাতে পারে না।
আর বই পড়ার ধারণা বা উপকার সম্পর্কে তাদের ধারনাও নাই। তাই তাদের বুঝাতে হয়েছিল বই শুধু বিক্রি করা নয় পড়াও যায়। শুরুতে অনেকে বই পড়তে চাইতো না। আমাকে তাদেরকে বুঝাতে হয়েছে। এখন পাঠক সংখ্যা বাড়ছে।
আমি প্রতি সপ্তাহে আমার গ্রামের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে বই দিয়ে আসি। পরের সপ্তাহে সেগুলো আবার ফিরিয়ে আনি, নতুন বই দিয়ে আসি। ১০-১৫ কিলো দূর থেকেও ফোন করলে সাইকেল দিয়ে বাড়ীতে গিয়ে বই দিয়ে আসি।
বিনা পারিশ্রমিকে এই কাজ করার কারণ জানতে চাইলে আতিফ জানান, ‘আমার এই কর্ম দেখে দেশের কয়েকটি জায়গায় পাঠাগার গড়ে তুলছেন। এছাড়াও অনেকে পাঠাগার করবেন বলে আমাকে জানাচ্ছেন। এটাই আমার বড় পাওয়া। আমি প্রত্যেকটি গ্রামে একটি করে পাঠাগার হোক। বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে।’
তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা সপ্তাহে ১ টি দিন, হোক শুক্রবার। আমরা যদি যার যার এলাকায় বই নিয়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে বই পড়ার আন্দোলনটা শুরু করি, তাহলে বই পড়ার স্বপ্নটা বেঁচে থাকবে।একটা নতুন জাগরণ সৃষ্টি হবে দেশজুড়ে।’ আতিফ জানান, ‘আরো কিছু বই পেলে লাইব্রেরীটি আরো সমৃদ্ধ হতো।’
কেউ চাইলে আতিফের লাইব্ররীর জন্য বই দিতে পারেন। কেউ বই বা অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে চাইলে আতিফের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তার মোবাইল নাম্বার- 01904818550.