আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে রাসুল (সা.) এর বিবাহ ও বর্তমান বাল্যবিবাহের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
- মো. রেজুয়ানুল হক
- প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৭ PM , আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০৮ PM
বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত রাসুলে আকরাম (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আগত সর্বশেষ নবি ও রাসুল। আইয়্যামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগের এমন এক সময়ে তার আগমন যখন পৃথিবী অন্যায়-অবিচার ও পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত ছিল। মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি অন্ধকার যুগে ঐশী আলো ছড়িয়ে দেন। ফলে অন্ধকার বিদূরিত হয়, পাপাচারে নিমজ্জিত মানুষগুলো খাঁটি সোনায় পরিণত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার। রাসুলে আকরাম (সা.) এই মহান মিশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যারপর নাই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। শরীরের ঘাম ঝড়িয়েছেন, রক্ত ঝড়িয়েছেন। বিরোধীরা তাদের প্রিয় আল আমিনকে পাগল আখ্যা দিয়েছে, কবি অভিধায় অভিহিত করেছে।
জাদুকর বলে রটনা রটিয়েছে। কিন্তু তার নিষ্কলুষ চরিত্র নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, আপত্তি করেনি। ইতিহাস ও সিরাতের কোনো গ্রন্থে তার চরিত্র নিয়ে আপত্তির অধ্যায় নেই। কারো মন্তব্যেরও অস্তিত্ব নেই। দুঃখের বিষয় হলো- প্রায় চৌদ্দশত বছর পরে কতিপয় অবুঝ ব্যক্তি রাসুলে আকরাম (সা.) এর পবিত্র চরিত্রে এমন কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চালাচ্ছে যা তার সমসাময়িক শত্রুরাও কখনো কল্পনা করেনি। সমকালীন সমালোচকদের প্রধান দুটি অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করাই এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্যেশ্য। প্রথম অভিযোগ হলো তার বহুবিবাহ।
রাসুল (সা.) মোট ১১টি বিয়ে করেছিলেন। ১১ জন স্ত্রীর নাম-
১. হজরত খাদিজা (রা.)
২. হজরত সাউদা বিনতে জামআ (রা.)
৩. হজরত আয়েশা (রা.)
৪. হজরত হাফসা বিনতে উমর (রা.)
৫. হজরত জয়নব বিনতে খুজায়মা (রা.)
৬. উম্মু সালমা বিনতে আবু উমাইয়া (রা.)
৭. জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)
৮. জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা.)
৯. উম্মু হাবিবা বিনতে আবি সুফিয়ান (রা.)
১০. সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই (রা.)
১১. মায়মুনা বিনতে হারিস (রা.)
তার এগারো জন স্ত্রীর মধ্যে মাত্র একজন কুমারী ছিলেন- হজরত আয়েশা রা.। অবশিষ্ট দশজন ছিলেন বিধবা এবং অনেকেরই আগে সন্তান হয়েছিল। যেমন হজরত খাদিজা রা. এর আগে দুটি বিয়ে হয়েছিল এবং তার তিনজন সন্তান ছিল। আবার অনেকেই ছিল তার সমবয়সী ও বয়স্ক মহিলা। তার ইন্তেকালের পূর্বেই ২ জন স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। তারা হলেন হজরত খাদিজা রা. ও হজরত জয়নব বিনতে খুজায়মা রা.। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের সময় নয়জন স্ত্রী জীবিত ছিল।
রাসুল (সা.) এর বহুবিবাহের প্রেক্ষাপট ও কারণ আলোচনার পূর্বেই আমাদেরকে একটি হাদিস স্মরণ রাখতে হবে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, না আমি বিবাহ করেছি এবং না স্বীয় কন্যাকে বিবাহ দিয়েছি যতক্ষণ না জিব্রাইল (আ.) ওহি নিয়ে আমার নিকট আগমন করেছে। (সীরাতুল মুস্তফা -৩/২৬০) অর্থাৎ তিনি ১১টি বিবাহ নিজ ইচ্ছায় বা আনন্দ ফূর্তির জন্য করেননি। মহান আল্লাহ তার জন্য যা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাই তিনি প্রতিপালন করেছেন মাত্র।
এবার আমরা এর প্রেক্ষাপট ও কারণ অনুসন্ধান করব।
এক) মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। (সুরা আহজাব, আয়াত-২১)
মানুষের জীবনের দুটি দিক রয়েছে- একটি বাহ্যিক দিক অপরটি অভ্যন্তরীণ দিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু উন্মতের জন্য এক মহান আদর্শ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব তাই তার জীবনের দুটি দিকই সবার সামনে উন্মোচিত হওয়া অত্যাবশ্যক। তার জীবনের বাহ্যিক দিকের খুঁটিনাটি বিষয় সাহাবায়ে কিরামের বর্ণনায় নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। অভ্যন্তরীণ দিকটি উঠে এসেছে তার পবিত্র স্ত্রীগণের অনবদ্য বর্ণনায়, কথায় ও কাজে। এটি সর্বজনবিদিত যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার বিষয়গুলো তারা ছাড়া অন্য কেউ পূর্ণাঙ্গভাবে জানেন না। এটি সম্ভবও না। পৃথিবীর সকল স্ত্রী তাদের স্বামীর বিষয় যতটা গভীরতার সঙ্গে জানে তা অন্য কেউ জানে না। পবিত্র স্ত্রীগণ তার অভ্যন্তরীণ জীবনের সকল বিষয় উন্মতের সামনে তুলে ধরেছেন পরম যত্নে, অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। এক্ষেত্রে একজনের বর্ণনার চেয়ে একাধিক ব্যক্তির বর্ণনা নিশ্চয় উম্মাহর মধ্যে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ফলে রাসুল (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীগণ সংখ্যায় ও গণনায় স্ত্রী হলেও তারা একেকজন ছিলেন তার অভ্যন্তরীণ জীবনের অনবদ্য ভাষ্যকার।
দুই) রাসুল (সা.) একটি মহান দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই দায়িত্ব পালনে বহুমুখী কৌশলের একটি ছিল বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। আরবদের রীতি অনুযায়ী জামাইকে তারা খুব মান্য করত। তার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোও ছিল নিন্দনীয় কাজ। বাসুল (সা.) বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইসলামের শত্রু কমিয়ে তার মিশন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। যেমন উম্মু সালমা (রা.) ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের। এই গোত্রের একজন বিখ্যাত বীর ছিলেন হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)। রাসুল (সা.) হজরত উম্মু সালমা (রা.) কে বিবাহ করার কারণে এই গোত্র শত্রুতা কমিয়ে দেয়। এক সময় হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কার অন্যতম সরদার আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মু হাবিবা (রা.) কে বিবাহের ফলে তিনি কখনো রাসুল (সা.) এর মুখোমুখি হননি। এক পর্যায়ে সপরিবার ইসলাম গ্রহণ করেন।
হজরত জুয়াইরিয়া (রা.) কে বিবাহের পর তার গোর বনু মুস্তালিক এবং হজরত সাফিয়্যা (রা.) কে বিবাহের পর তার গোত্র বনু নজির রাসুল (সা.) এর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করেছে এমন প্রমাণ নেই। অর্থাৎ তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমেও ইসলাম প্রচারের চেষ্টাই করেছেন। শুধু তাই নয় চার খলিফার সঙ্গেও তার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত উমর (রা.) ছিলেন শ্বশুর এবং হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলি (রা.) ছিলেন জামাতা।
তিন) রাসুল (সা.) এর বহুবিবাহ উম্মাহর কল্যাণ সাধন বৈ কিছুই ছিল না। তিনি বায়োলজিক্যাল ডিমান্ড পূরণের জন্য এতগুলো বিয়ে করেননি। এর পেছনে অনেকগুলো যুক্তি রয়েছে। যেমন-
* তিনি প্রথম বিয়ে করেছেন ১৫ বছরের বড় একজন বিধবাকে ভদ্র মহিলাকে যিনি তিন সন্তানের জননী ছিলেন। আরবে তার জন্য সুন্দরী মেয়ের অভাব ছিল না। কাফেরদের বহু লোভনীয় প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন যা সর্বজনবিদিত।
* ১১ জন স্ত্রীর মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন কুমারী। অথচ বর্তমান সময়েও স্বেচ্ছায় বিধবা ও বয়সে বড় মেয়েদের বিয়ে করতে চায় এমন পুরুষ নেই বললেই চলে। যারা সমালোচনায় মুখর তারাও এ ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি হবেন না নিশ্চয়।
* জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু (৬৩ বছর জীবনের ৫০ বছর) তিনি কাটিয়েছেন একজন বিধবা ভদ্র মহিলার সঙ্গে। জীবনের শেষ ১৩ বছরে কিভাবে তার এতটা বায়োলজিক্যাল ডিমান্ড হলো বা আমোদ প্রমোদের স্বাধ জাগল যে তাঁকে পরপর ১০টি বিয়ে করতে হলো। কেনই বা বয়স্ক বিধবা মহিলাদেরকেই পছন্দ করা হলো। অথচ তার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বহু পরিবার আগ্রহী ছিল।
চার) সবচেয়ে বড় বিষয় হলো চৌদ্দশত বছর আগের সামাজিক অবস্থাকে আজকের সামাজিক রীতি-নীতির সঙ্গে তুলনা করা। তৎকালীন বিশ্বে বহুবিবাহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি রীতি ছিল। কেউ এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখত না। ইসলাম এক বিবাহকে উৎসাহিত করেছে ও শর্ত সাপেক্ষে চার বিবাহ পর্যন্ত সুযোগ রেখেছে। রাসুল (সা.) এর চারের অধিক বিবাহ ইসলামের বিধান মতে একটি বিশেষায়িত বিষয়। এর দুটি মৌলিক কারণ হলো- ক. তার স্ত্রীগণ মুমিনদের মা। তাঁদের সঙ্গে কারো বিবাহ বৈধ নয়। রাসুল (সা.) চারজন স্ত্রীকে রেখে বাকিদের তালাক দিলে সারাজীবন তাঁদেরকে বিধবা থাকতে হতো। খ. এছাড়া তার বিবাহবন্ধনে থাকতে পারা একটি সৌভাগ্যের বিষয়। তিনি কোন চারজনকে রাখবেন আর কাদেরকে তালাক দিবেন এটি তার জন্য সহজ বিষয় ছিল না। যেহেতু তিনি কারও প্রতি বৈষম্য করতেন না।
পাঁচ) রাসুল (সা.) এর বিরুদ্ধে কাফিররা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে বা অভিযোগ করতে সক্ষম হয়নি। যাকে দেশান্তরী করার পরিকল্পনা হয়েছে, হত্যার জঘন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তাকেও তারা 'আল আমিন' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তারা তাকে পাগল বলেছে, গণক ডেকেছে, কিন্তু তার চারিত্রিক দুর্বলতার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তুলেনি। তার ইন্তেকালের শতশত বছর পরেও পৃথিবীর কেউ এমন প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস দেখায়নি। কেননা সিরাতের গ্রন্থগুলোতে তার বহুবিবাহ সংক্রান্ত উত্থাপিত কোনো প্রশ্নের খণ্ডনের অধ্যায় নেই। এতে বুঝা যায় এসব গ্রন্থ রচনার সময়েও তার বিরুদ্ধে উপর্যুক্ত অভিযোগ বা সমালোচনা ছিল না।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আজ চৌদ্দশত বছর পর রাসুল (সা.) এর নিষ্কলুষ চরিত্রে কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।
মহানবী (সা.) এর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ তিনি বাল্যবিবাহ করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) কে ছয় বছর বয়সে বিবাহ করা ও নয় বছর বয়সে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এই অভিযোগের একমাত্র ভিত্তি। সংসার শুরু হয়েছে নয় বছর বয়সে। সুতরাং এটিই বিবাহের বয়স হিসেবে গন্য হবে।
রাসুল (সা.) এর সঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) এর বিবাহ সংক্রান্ত নিম্নোক্ত আলোচনা প্রণিধানযোগ্য-
এক) ইসলামে ছেলে মেয়েদের বিবাহের বয়স নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। প্রাপ্তবয়স্ক হলেই তাদের বিবাহ ইসলামি আইন অনুযায়ী সিদ্ধ। সুতরাং ইসলামের বিধান মতে বাল্যবিবাহ নির্ণয়ের পন্থা বয়স নয়, শারীরিক সক্ষমতা বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। শারীরিক সক্ষমতা নয় বছর বয়সে হয় কিনা সেটি বিচার করার জন্য আমাদেরকে ঐ সময়ের আরবে ফিরে যেতে হবে। নয় বছর বয়সে আরবে বিবাহের প্রচলন ছিল। শুধু তাই নয় রাসুল (সা.) এর সঙ্গে বিবাহের আগেই মুতইম ইবনে আদির পুত্রের সঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) এর বিবাহের একটি প্রস্তাব এসেছিল। হজরত আবু বকর (রা.) এতে সম্মতিও দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয় তার বিবাহ অযোগ্য মেয়ের জন্য প্রস্তাবে রাজি হননি। মহানবী (সা.) যখন খাওলা বিনতে হাকিমের মাধ্যমে হজরত আবু বকরের নিকট হজরত আয়েশাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান তখন তিনি (হজরত আবু বকর) মুতইম ইবনে আদির বাড়িতে যান এবং পূর্বের প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু তারা তাদের ছেলে এই বিবাহের ফলে ইসলাম গ্রহণ করবে এই ভয়ে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। ফলে হজরত আবু বকর মহানবী (সা.) এর প্রস্তাবে রাজি হন। (সীরাতুল মুস্তফা-৩/২০)
তিনি (মহানবী সা.) বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার পরও হজরত আবু বকর মুতইম ইবনে আদির বাড়িতে গিয়েছিলেন শুধুই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবার আশঙ্কায়।
দুই) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'যখন কোনো মেয়ে নয় বছর বয়সে উপনীত হয় তখন সে মহিলা (প্রাপ্তবয়স্ক) হয়ে যায়। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস নম্বর-১১০৯) অর্থাৎ তৎকালীন আরবে মেয়েরা নয় বছর বয়সেই বিবাহের উপযুক্ত হয়ে যেতো।
তিন) রাসুল (সা.) মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হাজরত আয়েশা (রা.) কে বিয়ে করেছিলেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) তাকে বলেছেন, দুইবার তোমার চেহারা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। আমি দেখলাম, তুমি একটি রেশমি কাপড়ে আবৃতা এবং (জিবরাইল) আমাকে বলছেন, ইনি আপনার স্ত্রী। আমি ঘোমটা সরিয়ে দেখলাম। দেখি ঐ নারী তো তুমিই। তখন আমি ভাবছিলাম, যদি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে তিনি তা বাস্তবায়িত করবেন। (বুখারি শরিফ, হাদিস নম্বর- ৩৮১৫, ৫০৭৮)
ইতঃপূর্বে আরো একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুটি হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি বিবাহের ব্যাপারে নিজের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি বরং মহান আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত অবনত মস্তকে মেনে নিয়েছেন মাত্র।
চার) হজরত আয়েশা রা . এর বিবাহকে বাল্যবিবাহ গণ্য করা নিছক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। প্রাচীন যুগের ১৪০০ বছর পূর্বের একটি বিয়ের ব্যাপারে যারা খুবই সোচ্চার তারাই আধুনিক যুগের বাল্যবিবাহ সম্পর্কে অন্ধ। কতিপয় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো -
১. গোলাম মুরশিদ বলেন, দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাঙালি সমাজে বিয়ে হতো খুব কম বয়সে, প্রেমের অনুভূতি জেগে ওঠার আগেই। মেয়েদের বিয়ে হতো আট-দশ বছর বয়সে। (হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি-২০৮)
একশো বছর আগে বাঙালি সমাজে মেয়েদের বিয়ে হতো আট বছর বয়সে। চৌদ্দশত বছর আগে ভিন্ন সংস্কৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির একটি দেশে নয় বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে নিয়ে সমালোচনা উদ্যেশ্য প্রণোদিত। এই আধুনিক যুগেও গত আগস্ট ২০২৪ ইরাকের সংসদে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ৯ বছর করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। (এনডি টিভি, ১০ আগস্ট ২০২৪)
২. গোলাম মুরশিদ আরো চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেন, বঙ্কিমচন্দ্র যাঁকে বিয়ে করেছিলেন, তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। দেবেন্দ্রনাথ ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর স্ত্রীর বয়স ছিল ছয় বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর বয়স ছিল সাত বছর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর বয়স আট বছর, কেশব সেন এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নয়, শিবনাথ শাস্ত্রীর দশ আর রাজনারায়ণ বসুর স্ত্রীর বয়স ছিল এগারো বছর। (হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি-২২০)
পাঁচ) হজরত আয়েশা (রা.) কে বিয়ের মাধ্যমে জাহেলি সমাজের একটি প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে সময় মুখে বলা ভাই ও পাতানো ভাইকে অনেকেই আপন ভাইয়ের মর্যাদা দিতো। এমনকি এমন ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। হজরত আবু বকর ছিলেন মহানবী (সা.) এর বন্ধু ও পাতানো ভাইয়ের মতো। এই বিয়ের মাধ্যমে এই রেওয়াজ দূর হয়ে গেল যে, মুখে বলা ভাই আপন ভাইয়ের মতো এবং একইসাথে ঐ ভাইয়ের মেয়েকেও বিয়ে করা যাবে না। স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে আয়েশা (রা.) কে বিয়ে করার মাধ্যমে জাহেলি কুসংস্কার রহিত করে দিলেন। যদি তিনি বিষয়টি মুখে বলে নিষিদ্ধ করতেন, তাহলে এমনও হতে পারত যে, খুব সহজে পাতানো ভাই ও ভাতিজির সম্পর্ক সমাজ থেকে নির্মূল হতো না। কিন্তু তিনি নিজে যখন মুখে বলা ভাই আবু বকর (রা.) এর মেয়ে আয়েশা (রা.) কে বিয়ে করলেন, তখন চিরদিনের জন্য জাহেলি সমাজের প্রাচীন এই কুরসম রহিত হয়ে গেল।
বর্তমান সমাজেও এই পাতানো সম্পর্কের ভয়াবহতা উদ্বেগজনক। ইসলাম এটিকে শুধু আইন করেই নয় বরং হজরত আয়েশা (রা.) কে রাসুল (সা.) এর বিবাহের মাধ্যমে প্রাক্টিক্যালি নিষিদ্ধ করেছে।
লেখক: প্রভাষক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা), ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, শ্রীবরদী সরকারি কলেজ।