জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
ক্লাস না করেই অনার্স পাশ!
- হোসাইন আরমান
- প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ০১:৪৫ PM , আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২২, ০৪:০৩ PM
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই কয়েক হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক পাশ করছেন। অভিযোগ উঠেছে, ক্লাস করা ছাড়াই চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করছেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। কেউ কেউ ফলাফলও ভালো করছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস না নেয়ায় কলেজে আগ্রহ পান না তারা। আর শিক্ষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ক্লাসের মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশে ১৯১৯ টি কলেজে ডিগ্রি, ৮৪৭টি কলেজে অনার্স এবং ১৭৬ টি কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানান, অনার্সে কিছুটা ক্লাস হলেও ডিগ্রি, মাস্টার্সে ক্লাস হয়না বললেই চলে। অনার্স ১ম বর্ষে ক্লাসে উপস্থিতি যেমন থাকে ২য় বর্ষ থেকে সেটি ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সময়ের সাথে নানা কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের আগ্রহে ভাটা পড়ে যায়। বিজ্ঞান শাখার বিভাগগুলোতে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা থেকে তুলনামুলক অনেক বেশি ক্লাস হয়। কিছু কিছু বিভাগে ১ম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর কয়েকদিন ক্লাস হলেও এরপরে আর কোন ক্লাসই হয়না। শিক্ষাথীরাও ক্লাস করতে আসেনা। শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করছেন।
আরও পড়ুন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ‘পুনরায়’ পরীক্ষা নেওয়ার দাবি
জানা যায়, জবাবদিহিতা নেই বলে অনেকে ইচ্ছা করেই ক্লাসে আসেনা। এছাড়াও কর্মজীবনে প্রবেশ, শিক্ষার্থীদের বিয়ে হয়ে যাওয়া, ক্লাস রুম সংকট, শিক্ষক সংকট, মান সম্মত লেকচার, শিক্ষকদের অনাগ্রহ, কলেজ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ছাত্র রাজনীতির প্রভাব ইত্যাদি কারণে নিয়মিত ক্লাস হয়না বা শিক্ষাথীরা ক্লাসে উপস্থিত থাকেনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫% ক্লাস না করলে পরীক্ষা দিতে পারবেনা। কিন্তু পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় মানা হয়না সেই নিয়ম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে পাশ করা সিলেট এমসি কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি অনার্সের চার বছরে একদিনও ক্লাস করিনি। আমার রেজাল্ট কিন্তু ভালো। আমি ফাস্টক্লাস পেয়েছি। অনার্সে উঠার পর আমি একটা পার্টটাইম জব শুরু করি এজন্য আর ক্লাসে যাওয়া হতোনা। ক্লাস না করে একটা সাজেশান গাইড পড়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করা গেলে কষ্ট করে ক্লাস করার কি দরকার।
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া সাদিয়া নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরই আমার বিয়ে হয়ে যায় এরপর আর ক্লাস করার সুযোগ পাইনি। শুধু ইনকোর্স আর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। অন্য কোন পরীক্ষাও দিইনি। আগ্রহ থাকলেও সংসারের চাপে ক্লাস করার সুযোগ পাইনি।
২০১৭-১৮ সেশনে রাজশাহী সরকারি কলেজের গণিত বিভাগে থেকে অনার্স পাশ করা হাসিব ( ছদ্মনাম) বলেন, আমরা দেখেছি অনেক সময় শিক্ষকরা ফ্রি থাকলেও রুটিন সময় অনুযায়ী ক্লাসে আসতোনা। আবার কোন কোন স্যারের লেকচার একদম ভালো লাগতো না। এজন্য ইচ্ছা করে তাদের ক্লাস এড়িয়ে যেতাম। আবার অনেক শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমত পড়াতোনা, ক্লাস নিতোনা কিন্তু প্রাইভেটে ভালো করেই পড়াতো। এজন্য আমাদের বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস না করলেও ৪ বছর নিয়মিতই প্রাইভেট পড়েছে।
ফেনী সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আকতার হোসাইন বলেন, ক্লাস না করলেও সবাইকে চাপ দেয়া যায়না। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। ক্লাস না করলে বা ইনকোর্স, ভাইভাতে কম নম্বর দিলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের নিয়ে এসে শিক্ষকদের হেনস্তা করে এজন্য অনেক শিক্ষক ঝামেলা এড়াতে নম্বর দিয়ে দেয়।
চট্রগ্রাম সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল জানান, ১ম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত আমাদের রুটিন করা থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আসে না। তারা না আসলে আমরা কাকে ক্লাস করাবো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আগ্রহ কম। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা কিছুটা ক্লাস করলেও অন্য বিভাগে সেটাও চোখে পড়েনা।
আরও পড়ুন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে এবার বাড়বে জিপিএ
তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অনেক দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে ভাড়া দিয়ে এসে ক্লাস করতে গেলে দেখা যায় শিক্ষকরা ঠিকমত ক্লাস নেয় না। ব্যস্ততার অযুহাতে সময়মত ক্লাস করায় না।
তবে শিক্ষকরা বলেন, অধিকাংশ কলেজেই শিক্ষক সংকট। অনার্স-মাস্টার্স মিলিয়ে চলমান ৬-৭ ব্যাচের কয়েকশ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক থাকে ২-৩ জন। তাদরেকে আবার উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস ও করাতে হয়। এজন্য রুটিন দেয়া থাকলেও সময়মত ক্লাস নেয়া সম্ভব হয়না। আবার ক্লাসরুম সংকটের কারণেও সব সময় সবার ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। এভাবে ২-৩ দিন ক্লাস না নিলে পরে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যায়। ক্লাস করার আগ্রহ হারিয়ে পেলে। একটা সময় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসাই বন্ধ করে দেয়। এ সমস্যা সমাধান করতে হলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং ক্লাস রুমের ব্যবস্থা করতে হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যপক ড. মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনুযয়ী ৭০% ক্লাস না করলে পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফরম পূরণ করতে পারবেনা। এবং আমাদের কাছে ডাটা আছে শিক্ষার্থীরা ৭০% ক্লাস করে বলেই ফরম পূরণের অনুমতি দেয়। যদি কেউ ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, শিক্ষক এবং ক্লাস রুম সংকটের কারণে অনেক সময় ক্লাস হয় না। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা চেস্টা করছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাস না করার ব্যাপারে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকল শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেয়না। শিক্ষার্থীরাও ক্লাস না করে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়। শতভাগ ক্লাস করানো শিক্ষকদের পক্ষে যেমন সম্ভব না তেমনি শিক্ষার্থীরাও করবেনা।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় কলেজের বাইরের লোক এসে প্রভাব খাটাতে চায়। কিন্তু আমরা এখন এটাকে কঠোরভাবে দেখছি যেখানে অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে পদক্ষেপ নিচ্ছি। যদি কোন কলেজে কেউ এরকম প্রভাব খাটাতে চায় বা শিক্ষরা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্লাস করা ছাড়া পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিবো। তবে আমাদেরকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিতে হবে।