বাউবির ওপেন স্কুল

পরীক্ষার রুটিন তৈরির কাজ শেষ হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি ১২ পাঠ্যবই

বাউবি লোগো
বাউবি লোগো  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) অধীনে ওপেন স্কুলের চলতি শিক্ষাবর্ষের এসএসসি ও এইচএসসির ইতিহাস সংক্রান্ত ১২টি সংশোধিত বই এখনও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে পরীক্ষার রুটিন তৈরির কাজ, চলছে প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ, অব্যাহত রয়েছে মডারেশন প্রক্রিয়া। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইতিহাস সম্বলিত বইগুলোর সংশোধন প্রক্রিয়া এখনো নেই কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। শুধুমাত্র একটি চিঠি দিয়ে দায় সেরেছে বাউবি প্রশাসন। পাঠ্যপুস্তক রিভিউ যাচাই-বাঁছাই কমিটি সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দিলেও গঠিত কারিকুলাম কমিটিতে আওয়ামী ঘরোনার লোকজন থাকায় তারা জটিলতা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে সংশোধিত বইগুলোর বিলম্বের কারণে শিক্ষার্থীরা পুরোনো বিতর্কিত বই নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুন বই ছাপানোর কারণে বাউবির গচ্ছা যাচ্ছে প্রায় দেড়কোটিরও বেশি টাকা।  

জানা যায়, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পরে ইতিহাস সংক্রান্ত ১২টি বই কয়েকটি প্রোগ্রামের পাঠ্যসুচিতে বিতর্কিত ইতিহাস যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজনবোধ করে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) প্রশাসন। বাংলাদেশের ইতহিাসের অভ্যুদয় সংক্রান্ত এইচএসসি বাংলা দ্বিতীয়পত্র, পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয়পত্র, সমাজ বিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র, ইতিহাস প্রথমপত্র, এসএসসির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় দ্বিতীয়পত্র, এইচএসসির পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয়পত্রসহ আরও পাঁচটি ইতিহাস সম্বলিত বই। গত বছরের অক্টোবরে বিতর্কিত ইতিহাস লেখা বইগুলো পাঠ্যপুস্তক থেকে যাচাই বাছাই করার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। রিভিউ কমিটি বাউবির কারিকুলাম কমিটিতে তাদের সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে রিভিউ কমিটি সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় দীর্ঘদিনেও সুপারিশ বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ নেয়নি কারিকুলাম কমিটি।

আরও পড়ুন: ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে অংশীজনদের বিশেষ আহ্বান মন্ত্রণালয়ের 

অভিযোগ রয়েছে,  শেখ মুজিবুর রহমানের বিতর্কিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে বাংলা প্রথমপত্রে ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ সংকলন করা হয়েছে। সম্প্রতি বইটির লেখক নিয়ে তুমুল বির্ত্ক শুরু হয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে লেখক জালিয়াতির ঘটনায় দুদক সক্রিয় হলেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্টো চিত্র। বাউবির ওপেন স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বিকৃতিকারীরাও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ৯টি ইতিহাস বই লেখা হয়েছে। অভিযোগও উঠেছে, যার মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এসব বইয়ে পক্ষপাতমূলক ও বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে, বিশেষ করে আওয়ামী ঘরোনার লেখক ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা এসব বইয়ের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক মতবাদ পাঠ্যপুস্তকে ঢোকানোর চেষ্টা করেছেন। 

‘সম্পূর্ণ পরিমার্জন না করে আমরাতো মুদ্রণের জন্য দিতে পারি না। যারা এই ইতিহাসগুলো বইয়ে ইচ্ছা করে ঢুকিয়েছেন, তারাই কোর্স টিচার, তারা আমাদের কোন সহযোগীতা করছেন না। এখানে অনেকেই ফ্যাসিস্টের দোসর হওয়ার কারণে তারা হয়তো চাইছে না এটা পরিমার্জন হোক। আরেকট মজার ব্যাপার হলো ইতিহাসের জন্য আলাদা বই থাকলেও, তারা ইচ্ছে করেই বাংলা বইয়েও ইতিহাস এনেছে, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়াও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নাহ এমন ইতিহাস যুক্ত করা হয়েছে।’- কারিকুলাম কমিটি

সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী বিকৃত ইতিহাস রচনা সম্পাদনা ও সংযোজনে বাউবির সাবেক ভিসি আবদুল মান্নানের ছেলে ওপেন স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক জাহেদ মান্নানের প্রতক্ষ্য নির্দেশনায় বইগুলো লেখা হয়। বই গুলো ঘেটে দেখা যায়, এইচএসসি ইতিহাস প্রথমপত্র রচনায় ছিলেন প্রফেসর একেএম শাহনেওয়াজ প্রফেসর শরিফ উল্লাহ ভূইয়া, শহিদুল হাসান, আহম্মেদ শরীফ, তপন কুমার পালিত, বাউবির সাবেক ট্রেজারার ড. আশফাক হোসেন; এসএসসির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বই রচনা করেছেন প্রফেসর মাহবুবুর রহমান,আশফাক হোসেন, সুলতানা নিগার চৌধুরী ও সম্পাদনা করেছেন মুনতাসীর মামুন। এসএসসির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় দ্বিতীয়পত্র রচনায় ছিলেন ড. ইকবাল হুসাইন, মো আব্দুস সাত্তার, সুদীপ রায়, তপন কুমার পালিত, ড. জাকিরুল ইসলাম, শাহীনা আক্তার, মারুফ মিয়া, রণজিত কুমার নাথ সম্পাদনা করেছেন তৎকালীন বাউবির প্রোভিসি ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন, ড. আশফাক হোসেন, মেসবাহ উস সালেহীন, ড. প্রিয়ব্রত পাল, শান্তনু মজুমদার। 

এছাড়া এইচএসসির পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয়পত্র বই রচনায় ছিলেন সুদীপ রায়, মনিরুল ইসলাম, গাজী আলিফ পারভীন, লিটন বল ও সম্পাদনায় ছিলেন শান্তানু মজুমদার। এইচএসসি সমাজ বিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র রচনায় ছিলেন তৎকালীন প্রোভিসি মাহবুবা নাসরীন, ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন, আব্দুস সাত্তার, দেবাশীষ কুমার কুন্ডু, দিলীপ কুমার ঘোষ ও সম্পাদনায় ছিলেন দুই প্রোভিসি মাহবুবা নাসরীন ও খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন। এইচএসসি বাংলা দ্বিতীয়পত্র রচনায় ও সংকলনে ছিলেন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ে মেহেরিন মুনজারীন রতনা, ভীষ্মদেব চৌধুরী, সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান, ড. চঞ্চল কুমার বোস, জাহিদ হাসান সরকার। এসএসসি বাংলা প্রথমপত্র রচনায় ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ে মেহেরিন মুনজারীন রতনা, মোহাম্মদ আজম, কামাল উদ্দিন শামীম ও সম্পাদনায় ছিলেন ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ।

আরও পড়ুন: জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের ৬ ‘বিশেষ’ নির্দেশনা দিল মাউশি 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাউবির একজন শিক্ষক বলেন, ‘আওয়ামী বিকৃত ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর ‌অতিবন্দনা সংযোজনের সাথে যারা জড়িত সেই আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ইতিহাস বিকৃতিকারক শিক্ষকদেরকেই বর্তমানেও কারিকুলাম কমিটি গুরুত্বপূর্ণ স্কুল কমিটিতে বহাল রেখে চলছে ইদুর-বিড়াল খেলা। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না। মেহেরিন মুনজারীন রত্নার নেতৃত্বে দল বেঁধেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা। তাদের অসহযোগিতার ফসল গুণতে হচ্ছে বাউবি শিক্ষার্থীদের। বাউবি হচ্ছে কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন। আমরা এসকল আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শিক্ষকদের বিচার দাবি করছি।  

‘এটি নিয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। খুব শীঘ্রই শিক্ষার্থীদের হাতে বই যাবে। তবে বই না দিতে পারলেও, আমরা সংশ্লিষ্টদের সফট কপি সরবরাহ করেছি। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য পাঠ্যগুলো পড়াতে পারেন।’ ভিসি অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল

তিনি বলেন, ‘কারিকুলাম কমিটির উদাসীনতাই এখন পর্যন্ত বই পৌছায়নি শিক্ষার্থীদের হাতে। তারা এখনো রিভিউ কমিটির সুপারিশ প্রতিবেদন বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ গ্রেহণ করেনি। ফলে ওপেন স্কুলের শিক্ষার্থীরা হাতে পায়নি ১২টি বই। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।’

তিনি জানান, বাউবির ইতিহাস বইয়ে ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে উল্লেখ করার কারণে ওপেন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত এবং তাদেরকে পদন্নোতি বঞ্চিতও হয়েছেন। বর্তমান উপ উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহম্মেদের কন্যা অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত নাজনীনও আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের কুৎসিত ভৎসনা ও হয়রানির শিকার হন।

বাংলাদেশের অদ্ভ্যূদয়ের ইতিহাস রিভিউ কমিটির একজন বলেন, আমাদের কাজ আমরা করেছি। কিন্তু কোন একটি অদৃশ্য কারণেই এগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আনিসুর রহমান বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারিকুলাম কমিটির একজন বলেন, ‘সম্পূর্ণ পরিমার্জন না করে আমরাতো মুদ্রণের জন্য দিতে পারি না। যারা এই ইতিহাসগুলো বইয়ে ইচ্ছা করে ঢুকিয়েছেন, তারাই কোর্স টিচার, তারা আমাদের কোন সহযোগীতা করছেন না। এখানে অনেকেই ফ্যাসিস্টের দোসর হওয়ার কারণে তারা হয়তো চাইছে না এটা পরিমার্জন হোক। আরেকট মজার ব্যাপার হলো ইতিহাসের জন্য আলাদা বই থাকলেও, তারা ইচ্ছে করেই বাংলা বইয়েও ইতিহাস এনেছে, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। এছাড়াও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নাহ এমন ইতিহাস যুক্ত করা হয়েছে।’

তিনি জানান, প্রয়োজনের তুলনায় গায়েবি কারণেই দুই থেকে কয়েকগুন বই ছাপানো হয়েছে। যার পাণ্ডুলিপিগুলো এখন পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় দেড় কোটি টাকা লোকসান গুণতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন চাচ্ছে কিন্তু ফ্যাসিস্টদের দোসররা সহযোগীতা না করার কারণে মুদ্রণের জন্য এখনো ফাইনাল কিছুতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে কারিকুলাম কমিটি কাজ করছে। হয়তো খুব শীঘ্রই শিক্ষার্থীরা বই হাতে পাবে।’ 

বাউবির ভিসি অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল বলেন, ‘এটি নিয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। খুব শীঘ্রই শিক্ষার্থীদের হাতে বই যাবে। তবে বই না দিতে পারলেও, আমরা সংশ্লিষ্টদের সফট কপি সরবরাহ করেছি। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য পাঠ্যগুলো পড়াতে পারেন।’

ফ্যাসিস্টের যারা দোসরা যারা সহযোগীতা করছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পূজার ছুটি চলছে। ছুটি শেষে এ ব্যাপারে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া হবে। এছড়া গত ১৭ বছরের যারা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে ছিলেন তাদের খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং সেই কমিটি কাজ করছে।’

 


সর্বশেষ সংবাদ