ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়
- এ আর রাশেদ, ইবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৪:০৭ PM , আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০২:৩৪ PM
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে শুরু হয় বাঙালির স্বশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর বিজয়ের দেখা মেলে ডিসেম্বরে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা ছিল, তাই নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। যুদ্ধের দিনগুলো, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে দেশে অনেক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় ভাস্কর্য রয়েছে। যেগুলো চির জাগ্রত হয়ে যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো ফুটিয়ে তোলে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও (ইবি) রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ ও ‘শহীদ স্মৃতিসৌধ’। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করতে ১৯৯৬ সালে মুক্তবাংলা এবং ২০০১ সালে নির্মিত হয় শহীদ স্মৃতিসৌধ। এই ভাস্কর্য দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে।
মুক্তবাংলা
আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের আঙ্গিকে ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রশাসন ভবনের পূর্ব পাশে স্থাপিত হয় এই মুক্তবাংলা। খ্যাতিমান ডিজাইনার রশিদ আহমেদের নকশার ভিত্তিতে একে অপরূপ সৌন্দর্যে রূপ দেয়া হয়।
মুক্তবাংলার সাতটি স্তম্ভ সম্বলিত গম্বুজের ওপর রয়েছে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার রাইফেল, যা সাত সদস্যের মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রতীক। প্রতিটি স্তম্ভ বিস্তৃত প্রসারিত হাত ধরাধরি উল্লাসিত অবয়বে ইসলামী স্থাপত্য ভিত্তিক আর্চ রচিত, চোখে লাল সূর্য উদয়ের প্রত্যাশা, নিচে বিস্তৃত সিরামিক বড় ইট লাগাতর আন্দোলনের নির্দেশক।
উপর থেকে চতুর্থ ধাপে লাল সিরামিক ইট আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রতীক, দ্বিতীয় ধাপে কালো পাথর শোক ও দুঃখের প্রতীক, তৃতীয় ধাপে সাদা মোজাইক সন্ধি ও যোগাযোগের প্রতীক এবং বেদির মূল মেঝে সবুজ মোজাইক নীল টাইলস শান্তির প্রতীক। সম্পূর্ণ অবকাঠামোটি সাতটি আর্চ সম্বলিত একটি অর্ধ উদিত (উদিয়মান) সূর্য।
মুক্তবাংলা সৌন্দর্য ও বিশেষত্ব উপভোগ করতে শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রতিদিন দর্শনার্থীদের পদচারণা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের আগমন ঘটে এখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকতে ডানদিকে সবার নজর কাড়ে মুক্তিযুদ্ধের এই অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য কর্মটি।
শহীদ স্মৃতিসৌধ
দেশের অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিসৌধ সহজেই সবার নজর কাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার লীলাভূমিতে রূপান্তরিত করার প্রত্যয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিসৌধ।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শহীদদের স্মরণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০০১ সালে তাৎপর্যপূর্ণ শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী হাশেম খান এবং প্রখ্যাত স্থাপত্যবিদ রবিউল ইসলামের দেয়া মডেল ও স্থাপত্য কর্মের ভিত্তিতে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়।
৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা লাভের মূলধারা ও অতীতের সব ঘটনাকে স্মরণ রাখতে যথাক্রমে ৩০ ফুট, ৪২ ফুট ও ৫২ ফুট উচ্চতায় ২ ফুট ৬ ইঞ্চি পুরুর বিভিন্ন সংমিশ্রণে এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়েছে।
৭১ ফুট উঁচু পরিসরে ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট ইটের চত্বরে এই স্তম্ভটি স্থাপিত। যার ওপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের বেদি, প্রশস্ত পাটাতন, মাঝখানে ২১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট জাতীয় পতাকার দণ্ড এবং দুই পাশে ১০ ফুট উচ্চতার ৩৮ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা বিষয়ক (দুটি) দেয়ালচিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মরমী সাধক ফকির সম্রাট লালন শাহ, পাগলা কানাই ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণী সংযোজন স্মৃতিসৌধটির গুরুত্ব আরও অর্থবহ করে তুলেছে। এছাড়া গোলাকার জ্যামিতিক বৃত্ত, ব্যাসার্ধ, স্তম্ভ ইত্যাদি স্থাপত্য দেশের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়।