আমার বেড এখন খালি পড়ে থাকে: জবি শিক্ষার্থী খাদিজার মা
- জবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০১:৩২ PM , আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩১ PM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার মা ফাতেমা বেগম বলেন, আমি কই আর আমার সন্তান আজ কোথায়! এক বেডে মা মেয়ে ঘুমাইতাম। কত কথা কইতাম। আমার বেড এখন খালি পড়ে থাকে। আমার এই কষ্ট কাউকে দেখাইতে পারবো না, বুঝাইতেও পারবো না। মাঝ রাতে ঘুম থেকে জেগে কান্না করি। তিনি বলেন, "প্রথম প্রথম আমরা ঘুমাতেই পারিনি। এই কষ্ট কারে বুঝাবো? এডি অনেক কষ্টের। এমন কোন রাত যায়নি যে ঠিকঠাক ঘুমাইছি।"
কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাদিজার মা-ফাতেমা বেগম বলেন, "ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েটা আমার সাথে ঘুমাইতো। আমি বুঝাইতে পারবো না কারো আমার কষ্ট। একরাত ঘুমাইলে সাত রাত ঘুমাইতে পারি না। ঘুমের মধ্যে জেগে যায় চিন্তায়। আমি পাশে হাত দিলেই দেখি আমার বেড খালি এটাই সব থেকে খারাপ লাগে। না ঘুমিয়ে কত রাত কেটেছে তার ঠিক নাই। শুধু কি আমি! এমন অনেক রাত গেছে সবাই না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি। ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি কোনদিন । একটা বছর হয়ে গেলো শারীরিক,মানুষিক অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই শেষ হয়ে যাচ্ছি। "
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, "আমার মেয়ের পড়াশোনার দিকে খেয়াল ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দুই মাস পরেই এঘটনা ঘটলো। রাজনীতি সম্পর্কে ও কিছুই জানে না। মানুষ চুরি করে, ডাকাতি করে, খুন করে, আরও কত জঘন্য কাজ করে জামিন পায় কিন্তু আমার মেয়েটার জামিন হচ্ছে না। আমার মেয়ে আমারে জিগায় মা জামিনের ব্যাপারে কি করলা? আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। আমি ওর এই প্রশ্নের কাছে অসহায়। আমি এক অসহায় মা। আমার মেয়ের মুক্তি চাই। আমার মেয়ে সরকার বিরোধী কোন কথা তো বলেনি নিজের মুখে।"
এই মামলায় খাদিজা গ্রেফতারের পর পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে খাদিজার পরিবার। একটি বছর কেটেছে বেশ দুর্বিষহভাবে। সামাজিক ভাবে সমালোচনায় পড়েছেন বড় বোন সিরাজাউম মনিরা ও ছোট ভাই ফারদিন হাসান। বড় বোন স্নাতকোত্তর আর ছোট ভাই উচ্চ মাধ্যমিকে। বন্ধু বান্ধব ও কাছের মানুষদের দ্বারাও হেও আচারণের সম্মুখীন হয়েছে তারা। সেই সাথে ভয়ে এড়িয়ে গেছেন আশ পাশের মানুষ,পরিবার ও আত্নীয় স্বজন।
খাদিজার মা বলেন, এই মামলার কারণে আত্নীয় স্বজন, পরিবারের লোকজন কেউ আমাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলেনি। এড়িয়ে চলেছে। মানুষতো ফোন করাই বন্ধ করে দিছিলো প্রথম প্রথম। অনেক আত্নীয় স্বজন ছয় মাসে একদিনও ফোন দেয়নি মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে। সবাই পর করে দিয়েছে। নিজের আশেপাশের লোকজনও কথা বলেনি দীর্ঘদিন, যোগাযোগ করেনি। মামলা হওয়ার পর সবাই যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। সামাজিক অর্থনৈতিক সব দিক দিয়েই আমার ক্ষতি। জীবনে কখনও থানা পুলিশ কোর্টে যায় নি। মেয়ে গ্রেফতারের পর কোথায় যাবো কার কার কাছে গেলে ভালো হবে কেউ বলেনি। কাউকে পাশে পায়নি। বড় মেয়ে বোঝে। ওই যোগাযোগ করে সব করেছে।
তিনি বলেন, মানুষ বলে মেয়েটাকে কিভাবে বিয়ে দিবো? মেয়েটার কি উপায় হইবো। এমনও বলে মানুষ। আমি বলি আমার মেয়ে তো আর সন্ত্রাসী না, ডাকাতি না, স্মাগলার না।
খাদিজার বোন সিরাজাউম মনিরা বলেন, এক বছরে লাইফ থেকে অনেক কিছু চলে গেছে অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে গেছে। অনেক কিছু হারিয়েছি।
আরও পড়ুন: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমের ভিডিওটি র্যাগিংয়ের নয়
পরিবার মতে খাদিজা ছোট বেলা থেকেই ছিলো প্রচন্ড মেধাবী আর চৌকস। লেখাপড়ায় দুর্দান্ত গতির সাথে ফলাফলও ছিলো বেশ চমকপ্রদ। মাধ্যমিক- উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। শুর থেকেই নিজেকে গড়তে থাকেন লক্ষ্য ঠিক রেখে। তবে এই পথ বেকে যায় কিছু দিন গেলেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাগারে বন্ধী হয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।
সেই সাথে বন্ধী তার স্বপ্ন। এক বছর সময় ধরে কারাগারে থাকায় দ্বিতীয় বর্ষেই আটকে আছে খাদিজার শিক্ষাজীবন। কারাগারে থাকা সময়ে সুযোগ হয়নি পরীক্ষা দেওয়ার। তবে সর্বশেষ চতুর্থ সেমিস্টারে ভর্তি হবার সুযোগ হলেও চিন্তিত শিক্ষা জীবন নিয়ে। বিভাগীয় শিক্ষকরা বলছেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি একটানা দুই বছর ক্লাস না করে, পরীক্ষা না দেয়, তাহলে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার বিষয় সামনে চলে আসে। খাদিজাতুল কুবরাও অনেক দিন থেকে জেলে আছেন, ক্লাস করতে পারেন না। তার বিষয়টিও ওইদিকে চলে যাচ্ছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে।'
গত বছর শনিবার (২৭ আগস্ট) রাতে গ্রেফতার হয় খাদিজা। ২৮ আগস্ট প্রেরণ করা হয় কারাগারে। কেটে গেছে একটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে খাদিজার পিছনে তার পরিবারকে ব্যয় করতে হয়েছে মোটা অংকেট টাকা। গত এক বছরে খাদিজার মুক্তির জন্য চার লাখের বেশি টাকা ব্যায় হলে বলে জানান খাদিজার মা ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, মেয়েকে মুক্তির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক টাকা খরচ করেছি কিন্তু লাভ হলো না। প্রতি মাসে খাদিজার পিছনে তেরো থেকে পনেরো হাজার টাকা দিতে হয় ব্যায় হয়। যা আমাদের জন্য অনেক কষ্টকর। ওর বাপ বিদেশ থাকে। পরিবারে আয় রোজগারের আর কেউ নেই। আর কুলাইতে পারিনা। ওর বাপ টাকা পাঠাই মাস শেষে সব টাকা মানুষকে দিয়ে দিতে হয়। দেনা শোধ করতেই সব শেষ।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, খাদিজার কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে ২০২১ সালে। সেই থেকে প্রায়ই অসুস্থ থাকতো খাদিজা। নিয়মিত ঔষধ খেয়ে বেশ কিছু ভালো ছিলো। কিডনিতে পাথর অপারেশন ব্যায়বহুল হওয়াতে থেমে যায় অপারেশন। খাদিজার মা বলেন, খাদিজার বাবা বিদেশ থাকে। করোনা মহামারীর সময়ে দেশে এসে আটকা পড়ে যায়। সাত মাস বেকার থাকে দেশে। ওই সময়ে হাতে কোন টাকা পয়সা না থাকাই খাদিজার অপারেশন করা হয় নি। আমার মেয়ে আটক হবার কিছু দিন আগে অপারেশন করার কথা ভাবা হয় কিন্তু সেই সময়েও পিছিয়ে যায়। তারপর তো কারাগারে।
খাদিজার মায়ের অভিযোগ কারাগারে খাদিজার কিডনির সমস্যা বাড়লে কর্তৃপক্ষ তা গোপন করে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে খাদিজার রিপোর্ট করানো হয়। আমাদেরকে তা দেখায় না। রিপোর্টে সব কিছু স্বাভাবিক দেখানো হলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। প্রতি দশ দিন পর পর ঔষধ নিয়ে যেতে হয় কারাগারে।
খাদিজা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তার মুক্তির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন প্রকার সুপারিশ ও সহযোগিতা করেনি বলে মন্তব্য করেছেন মা ফাতেমা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মান-অপমানি হয়েছেন বলে জানান তিনি। খাদিজার মা ফাতেমা বেগম বলেন, আমার মেয়ে বলেছিলো মা তুমি চিন্তা কইরো না। আমি এক দুই দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে যাবো। কিন্তু সেই এক দুই দিন এক বছরে পরিণত হয়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিনাদোষে জেল খাটলো বিশ্ববিদ্যালয় কোন ভূমিকা রাখল না, মুক্তির জন্য সুপারিশ করলো না। উল্টো প্রক্টর স্যার মান-অপমানি কথা বলেছে। তার মতে বড় পদ-চাকরী পাওয়ার জন্য নাকি এসব কথা বলেছে খাদিজা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড.মোস্তফা কামাল বলেন, খাদিজার রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা। সরকার বিরোধী কাজে লিপ্ত মেজর দেলোয়ারের সাথে প্রোগ্রাম করা সহজ কথা না। আর ঘটনা ও মামলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের বিষয়। এটা পুলিশ বাদী মামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলা হলে ভিন্ন বিষয়। আদালত থেকে মুক্ত হয়ে আসলে সে পড়ালেখার সুযোগ পাবে। তখন আমরা দেখবো। আর মান-অপমানি কোন ঘটনা ঘটেনি।