কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা কে?

সালাহউদ্দিন আহমদ, লোগো ও লায়ন মুজিবুর রহমান
সালাহউদ্দিন আহমদ, লোগো ও লায়ন মুজিবুর রহমান

সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালেই এর প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্যোক্তা নির্ধারণ হয়ে যায়। যদিও প্রতিষ্ঠার সাত বছর পর কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হওয়া নিয়ে বিবাদ চলছে ট্রাস্টি সদস্যদের মধ্যে। অনুমোদনের পর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠানটির একজন ট্রাস্টিকে উদ্যোক্তা হিসেবে চিঠি দিয়ে আসছে। অন্যদিকে অনুমোদনের সাত বছর পর নতুন করে নিজেকে উদ্যোক্তা দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেকজন ট্রাস্টি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা কে হবেন?— এ নিয়ে তদন্তে নেমেছে খোদ উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা ইউজিসি।

আইন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাময়িক অনুমোদনের প্রথম শর্তই হলো অনধিক ২১ ও অন্যূন ৯ সদস্যের একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) গঠন। সে অনুযায়ী ১০ সদস্যবিশিষ্ট কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের অনুকূলে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে সিবিআইইউর অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন বিওটির চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। আর সেক্রেটারি ছিলেন লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান। বাকি আট সদস্যের সবাই বিওটি সেক্রেটারির স্ত্রী, ভাই, ভাতিজা ও শ্যালকসহ নিকটাত্মীয়। এজন্য মূলত বিওটি চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান—এ দুই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হতো সিবিআইইউ।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার এক পর্যায়ে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে গত বছর বিওটি চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বড় আকারের বিভাজন তৈরি হয়। এ দ্বন্দ্বের জেরে কয়েক মাস আগে বিওটির সভা করে সালাহউদ্দিন আহমদকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ না করা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষা করার জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়। তার স্থলে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান করা হয়েছে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমকে।

এ প্রসঙ্গে লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, আসলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি প্রপোজাল বুক জমা দিতে হয়। একটি ট্রাস্ট গঠন করতে হয়। প্রপোজাল বুকে প্রতিষ্ঠাতার নাম ও জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিত দেয়া থাকে। ডীড অব ট্রাস্টেও উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতার নাম স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটিও আমি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন দেয়া ইউজিসির পরির্দশন প্রতিবেদনে এগুলোর প্রমাণ রয়েছে। গত সাত বছরে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সব চিঠি উদ্যোক্তা হিসেবে আমার নামেই এসেছে। সুতরাং এ বিষয়ে কোনো বিতের্কের সুযোগ নেই। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা। সালাহউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি করায় তাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমনকি তার আগ্রহের কারণেই ট্রাস্টের চেয়ারম্যানও করা হয়। তবে তিনি অর্থ সংস্থান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করায় ট্রাস্টিদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়েছে। এখন তিনি সেটা মেনে নিতে না পেরে অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সাত বছর পর এর উদ্যোক্তা পুনরায় নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয়ে  আবেদন করেছেন, যা হাস্যকর। এমনকি ট্রাস্টিদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পরও নির্লজ্জের মতো সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজেকে বিওটি চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন।

অন্যদিকে নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা দাবি করে লায়ন মুজিবুর রহমানসহ তার পক্ষের সদস্যদের বাদ দিয়ে নতুন ট্রাস্ট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সালাহউদ্দিন আহমদ। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা পুনরায় নির্ধারণের জন্য সরকারের কাছে একটি আবেদন করেছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের একটি জনসভায় লাখো মানুষের সামনে আমাকে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেয়ার ঘোষণা দেন।  রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দিতে পারতাম না। মুজিবুরকে বিশ্বাস করে যোগাযোগকারী হিসেবে নিয়োগ করি। সেই সবকিছু দেখাশোনা করতো। মন্ত্রণালয়-ইউজিসির যোগাযোগও সে করতো। কয়েক মাস আগে তার বিভিন্ন অনিয়ম বিষয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা আমাকে জানায়। পরে খোঁজ নিয়ে তার এসব অনিয়মের প্রমাণ পাই। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করে নিজের মতো ট্রাস্ট গঠন করে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা করেছে মুজিবুর। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।

ইউজিসির তদন্ত চলমান: সিবিআইইউর উদ্যোক্তা নির্ধারণ বিষয়ে তদন্ত করে মতামত জানাতে ইউজিসিকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সে আলোকে ইউজিসির সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগমকে আহ্বায়ক ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করে ইউজিসি। অন্য দুই সদস্য হলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. মো. ফখরুল ইসলাম ও উপপরিচালক মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা নির্ধারণ বিষয়ে কাজ করছি। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন বিভিন্ন নথিপত্র ও আইন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এসবের ভিত্তিতে খুব শিগগির প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

এদিকে ইউজিসির এ তদন্ত কমিটির বিষয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন মুজিবুর রহমান। চিঠি বিষয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা নির্ধারণ হয় প্রতিষ্ঠাকালীন অবদানের ভিত্তিতে। প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টের বিভিন্ন সভায় এখন উদ্যোক্তা পুনর্র্নিধারণ বিষয়ের একটি তদন্তে ইউজিসির কর্মকর্তারা আমার কোনো সাক্ষাত্কারই নেয়নি। এছাড়া তদন্ত কমিটির কয়েকজন সদস্যের বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ রয়েছে। তাই এ বিষয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করে ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছি।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, আমি তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে বেশি কথা বলার সুযোগ নাই। তবে এতটুকুই বলবো, আমরা মুজিবুরকে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য ডেকেছি। তবে পরবর্তী সময়ে জানলাম, কোনো একটি মামলায় মুজিবুরকে জরিমানা ও কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাই আমরা সাক্ষাৎকারটি বাতিল করি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, ওনারা আমার সাক্ষাৎকার বাতিল করে আমি জেলে ছিলাম বলে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। এতেই তদন্ত কমিটির পক্ষপাতদুষ্টতা প্রমাণ পায়। যদি জেলে থাকতাম, তাহলে তো এমনিতেই সাক্ষাৎকারে যেতে পারতাম না। তাহলে সাক্ষাৎকার বাতিল করা হলো কেন? ওনারা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তো কিছু করতে পারবেন না, এজন্য আমাকে পাশ কাটিয়ে ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সত্য গোপনের চেষ্টা করছেন। যদি ইউজিসি কর্মকর্তারা আমার জেলে যাওয়ার কথা প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে মানহানি মামলা করবো। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন নথিগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রপোজাল বুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লায়ন মো. মুজিবুর রহমান ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে সালাহউদ্দিন আহমদের নাম রয়েছে। আর প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকারনামায় প্রথমে সালাহউদ্দিন আহমদ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান হিসেবে স্বাক্ষর করলেও পরবর্তীতে সেটি সংশোধন করে লায়ন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান উদ্যোক্তা হিসেবে স্বাক্ষর করেন।

সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির  বিওটি নিয়েও ঝামেলা চলছে। পরিস্থিতি ঠিক করতে আমাদের একটি তদন্ত দল কাজ করছে। এখন একজন অভিযোগ তুলেছেন, তদন্ত দল তার মতামত না নিয়ে প্রতিবেদন দিচ্ছে। এখনও তো প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি। কেউ যদি কিছু বলতে চাই, সবার কথাই শোনা হবে। যাচাই করা হবে। আমার কর্মকর্তারা বলছেন, আইন অনুযায়ী কোনো মামলায় সাজা পাওয়া ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ নেই। আসলে আইনের বিষয়টি আমার স্পষ্ট জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য: মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্যোক্তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হলে প্রতিষ্ঠাকালীন বিভিন্ন নথি, রেজ্যুলেশন, ট্রাস্টিদের অবদান ও আইনী ব্যাখ্যার বিষয়গুলো দেখতে হবে। সিবিআইইউ-এর  উদ্যোক্তা পুনরায় নির্ধারণ ও ইউজিসির তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইউজিসিকে এ বিষয়ে তদন্ত করে মতামত দিতে বলা হয়েছে। তারা বিষয়টি সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গেই করবে। যেহেতু তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেক্ষেত্রে কমিটি পুনর্গঠনেরও সুযোগ রয়েছে। তবে সে সিদ্ধান্ত ইউজিসিকেই নিতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ