জিয়াউর রহমানকে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়েছিল

৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১০ PM
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর © সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে দাফন করা হবে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তাকে প্রথমে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছিল।

পরে ঢাকায় এনে তৎকালীন শেরে বাংলা পার্কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়েছিল তখনকার সরকারের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায়।

শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবন লাগোয়া এই পার্কটিই পরবর্তীকালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে 'চন্দ্রিমা উদ্যান' নামকরণ করা হয়। পরে বিএনপি সরকারের সময়ে এর নাম হয় 'জিয়া উদ্যান'।

পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আবার 'চন্দ্রিমা উদ্যান' নাম ফিরে আসলেও আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর 'জিয়া উদ্যান' নামই সেখানকার সাইনবোর্ডে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু নাম পাল্টানো বা নতুন নামকরণ যাই হোক, সেখানে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সিদ্ধান্ত এসেছিল তখনকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন সরকারের দিক থেকেই, বলছিলেন রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।

আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় উপমন্ত্রী ছিলেন এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। জিয়াউর রহমানের জানাজা ও দাফনেও উপস্থিত ছিলেন তিনি।

তিনি বলছেন, "প্রস্তাবটা বিচারপতি আবদুস সাত্তারেরই ছিল। কেবিনেট তা সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত করে। পরে সেনাপ্রধান এরশাদও তা সমর্থন করেন। এর কারণ হলো জিয়াউর রহমান যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেজন্য সংসদ ভবনের কাছে দাফনের চিন্তাটা করা হয়েছিলো"।

এখন সেখানেই জিয়াউর রহমানের কবরের পাশেই মিসেস জিয়াকে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার দল বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, তাকে সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হচ্ছে।।

দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর মঙ্গলবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন খালেদা জিয়া।

নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের জন্য দুই দিনের সফরে ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

তার সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বিবরণ অনুযায়ী, প্রথমদিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক শেষে মধ্যরাতে ঘুমাতে যান মি. রহমান।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনাবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তার উপর গুলি চালায় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এরপর ৩০শে মে সকালে রেডিওতে প্রথমবারের মতো জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে ৩০শে মে দুপুরেই রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।

হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পরেই জিয়াউর রহমানের মরদেহ গোপনে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানেই একটি পাহাড়ের পাদদেশে মি. রহমানকে কবর দেওয়া হয় বলে তখনকার একাধিক পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ১৯৮১ সালের দোসরা জুনে দৈনিক সংবাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ৩০শে মে সকাল আটটা থেকে নয়টার মধ্যে সেনাবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আসে।

তারা নিহত রাষ্ট্রপতি মি. রহমানসহ অন্তত তিনজনের মৃতদেহ গাড়িতে তুলে 'অজ্ঞাত' স্থানে নিয়ে যায়।

ঘটনার পর ৩০শে মে সকালে সার্কিট হাউজে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর রেজাউল করিম রেজা। তিনি নিজেও পরবর্তীতে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

ওদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানার পর সেদিনই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় আনার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল বলে জানায় তৎকালীন সরকার।

কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ করতে না পেরে পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির মরদেহ ঢাকায় পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয় বলে তখন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান।

কিন্তু চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন বলে পরে এক বিবৃতিতে জানায় সরকার।

দৈনিক সংবাদের ১৯৮১ সালের ৩১শে মে তারিখের খবর অনুযায়ী, ৩০শে মে বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয়। সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেদিনই ঢাকায় গায়েবানা জানাজায় আবদুস সাত্তার বলেন "চট্টগ্রাম থেকে রেডক্রসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির লাশ আনার জন্য আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা জবাব দেননি। এই অবস্থায় আমরা গায়েবি জানাজা করছি"।

কিন্তু ৩১শে মে তারিখে এসে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সৈনিক এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা গেল। অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ ত্যাগ করে অনেকেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে শুরু করেন।

এর মধ্যেই সেনাবাহিনীর 'বিপথগামী অফিসার ও সিপাহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় সরকার।

নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্নেল মতিউর রহমান-সহ অভ্যুত্থানকারী বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যান ৩১শে মে রাতেই।

মেজর জেনারেল মঞ্জুর পালিয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম সেনানিবাস পুনরায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর মি. মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করে সেনানিবাসে আনার পর তিনিও গুলিতে নিহত হন।

পহেলা জুন জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ খুঁজতে বের হয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ (প্রয়াত বিএনপি নেতা)।

পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে মি. শাহ জানিয়েছিলেন যে, জিয়াউর রহমানের মরদেহ খুঁজে বের করার জন্য তারা কাপ্তাই রাস্তার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিলেন এবং অনুমানের উপর ভিত্তি করে নতুন কবরের সন্ধান করছিলেন।

তখন সেখানকার গ্রামবাসী একটি ছোট পাহাড় দেখিয়ে জানালেন কয়েকদিন আগে সৈন্যরা সেখানে একজনকে কবর দিয়েছে। গ্রামবাসীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হান্নান শাহ সৈন্যদের নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখেন নতুন মাটিতে চাপা দেয়া একটি কবর।

সেখানে মাটি খুঁড়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং আরো দুই সেনা কর্মকর্তার মৃতদেহ দেখতে পান তারা। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তুলে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনা হয়।

সেখান থেকে পরে হেলিকপ্টারে করে জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয়। এরপর ১৯৮১ সালের পহেলা জুন ঢাকায় আনার পর জনসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য ২রা জুন সকাল এগারটা পর্যন্ত মৃতদেহ সংসদ ভবনে রাখা হয়।

সংবাদ সংস্থা এনাকে উদ্ধৃত করে ২রা জুনের পত্রিকায় খবরে বলা হয় "আজ মঙ্গলবার (২রা জুন) বেলা সাড়ে বারোটায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর নয়া সংসদ ভবনের পাশের লেকের ধারে বেলা ১টায় প্রয়াত নেতার মরদেহ দাফন করা হবে"।

পরদিন ৩রা জুনের দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, "শেরে বাংলা নগরস্থ প্রস্তাবিত শেরে বাংলা নগর পার্কে কবরের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। পার্কটি 'নূতন সংসদ ভবন ও লেকের উত্তর পার্শ্বে এবং গণভবনের পূর্ব পার্শ্বে' অবস্থিত"।

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, "তখন জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনসহ অনেক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলো বিচারপতি সাত্তারের অস্থায়ী সরকার। দাফনের জায়গা নির্ধারণও তারাই করেছে"।

আর এ বিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলছেন, জিয়াউর রহমানকে সংসদ ভবন এলাকায় দাফনের সিদ্ধান্তে তখন সবাই একমত হয়েছিল, এমনকি তখনকার আওয়ামী লীগের এমপিরাও অনেকে জানাজা ও দাফনে অংশ নিয়েছিল।

"ওই জানাজাটিতে তখন দল মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল," বলছিলেন তিনি।

এর প্রায় ৪৪ বছর পর আজ সেই কবরের পাশেই দাফন করা হচ্ছে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে দেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

স্বামীর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় খালেদা জিয়া
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
খুলনা-৩ আসনে তিন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
নানা আয়োজনে নেত্রকোনায় কমরেড মনি সিংহের ৩৫তম প্রয়াণ দিবস পা…
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
পোশাক শ্রমিক দিপু হত্যা মামলায় আরেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্ত গ…
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর দিন বহিষ্কার, যা বললেন রুমিন ফারহানা
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী…
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫