দফতরে আবেদনের হিড়িক
মনোনয়নে পরিবর্তন চান বিএনপির তৃণমূল নেতারা
- তারেক সালমান
- প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২২ PM , আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৬ PM
আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ধানের শীষের মোট ২৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রথম দফায় ২৩৭টি এবং দ্বিতীয় দফায় ৩৬টি আসনে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে দলটি। প্রাথমিক এই ঘোষিত প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত নয় জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, ঘোষিত এই তালিকা দলের ‘সম্ভাব্য চূড়ান্ত মনোনীত প্রার্থী’। দলের নীতিনির্ধারণী মহল প্রয়োজন মনে করলে এই প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসতে পারে।
বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে প্রতিদিনই আবেদন জমা পড়ছে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে বিভিন্ন আসনে মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মী ও সমর্থকরা বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করছে। প্রায় শতাধিক আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে এসব কর্মসূচি হচ্ছে। কর্মসূচির সঙ্গে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে দলের হাইকমান্ড এবং কেন্দ্রে লিখিত আবেদন করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন জমা পড়েছে বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে।
লিখিত আবেদনে আন্দোলন ও সংগ্রামে নিষ্ক্রিয়, নৈতিক স্খলন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অসুস্থ এবং বিতর্কিতদের নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন এবং বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ওদিকে আবেদনে দলের ত্যাগী, যোগ্য, তরুণ এবং ক্লিন ইমেজের নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। অনেক আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলের ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে লিখিত আবেদন করেছেন। সেখানে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের দলের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক ও উন্নয়নধর্মী কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ষড়যন্ত্র থেমে নেই, নির্বাচন অতো সহজ হবে না: তারেক রহমান
এদিকে, ‘প্রাথমিক চূড়ান্ত মনোনীত’দের তালিকা প্রকাশের পর থেকেই সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পরে বিএনপি। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিজেদের অনুসারী নেতাকর্মী নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন বিক্ষোভ করে আসছেন। প্রথম দফার প্রার্থীতা ঘোষণা পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই এ কর্মসূচি চলে আসছে। মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, রাস্তা অবরোধ, টায়ার পোড়ানো, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল, প্রতিবাদ সভার পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর নিজ নিজ আসনের মনোনীতদের পরিবর্তনের দাবিতে লিখিত আবেদনও করছেন। আর বিএনপির নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের দফতরে এসব আবেদন অফিশিয়ালি জমা পড়ছে।
বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আবেদন জমা পড়েছে দফতরে। পরিবর্তন প্রত্যাশী নেতারা নিজ নিজ আসনে ঘোষিত প্রার্থীদের অগ্রহণযোগ্যতা, জনবিচ্ছিন্নতা, দলের দুঃসময়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে না থাকার বিষয়গুলো লিখিতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে তুলে ধরেছেন। অনেকে আবার আবেদনের পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়ে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরছেন।
মৌলভীবাজার -১ (বড়লেখা-জুড়ি) সংসদীয় আসনে প্রার্থীতা পরিবর্তনের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন কাতার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ি) আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী শরিফুল হক সাজু। সেখানে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠু।
আবেদনে সাজু লিখেছেন, ঘোষিত প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির থেকে উঠে আসা। মিঠু এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণের কাছে ৩১ দফা নিয়ে হাজির হননি। এমনকি বিএনপির স্থানীয় প্রথম সারির নেতাদের অনুরোধেও তিনি সবসময় মাঠে উপস্থিত নেই। আপনি যে কোনোভাবে খোঁজ নিলে অবগত, ৫ আগস্টের পর থেকে মিঠু মূলত বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছেন কিন্তু মাঠের সাধারণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।
আরও পড়ুন: জামায়াতে যোগদানের নেপথ্যে তারেক রহমানের বক্তব্যের বিরোধিতা, কী বলেছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান?
আবেদনে সাজু আরও লিখেছেন, অন্যদিকে আমি শরিফুল হক সাজু উঠান বৈঠকসহ নানা কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলাম এবং এখনও আছি। তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার জনপ্রিয়তা এলাকায় আমার প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার কার্যক্রম ও এসব আয়োজনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতির প্রমাণ রয়েছে। আমি ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে উঠে আসা বিধায় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ সব সংগঠনের তরুণ নেতারা আমাকে ভালোবাসেন এবং আমার এলাকাবাসী এর সাক্ষ্য দেবে।
বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বারবার ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তৃণমূলে তার প্রভাব পড়ছে না। এক্ষেত্রে বিতর্কিত প্রার্থীদের বাদ দিয়ে দলের যোগ্য ও ত্যাগীদের মনোনয়ন দেওয়া না হলে নির্বাচনের ফলে এর প্রভাব পড়বে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা পড়া আবেদনের মধ্যে চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মো. জালাল উদ্দিন। এই আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন নেতাকর্মীরা।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনেও প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় দফতরে। এই আসনে ঘোষিত প্রার্থী বিএনপির ব্যাংকিং ও রাজস্ব বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ।
তারা অভিযোগ তুলে ধরে বলেছেন, হারুন বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদেও ১৪১ নং আজীবন সদস্য হিসাবে লিপিবদ্ধ রয়েছেন (কপি সংযুক্ত)। হারুন বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের সঙ্গে আঁতাতও যোগাযোগ রক্ষা করে বিশেষ করে এইচটি ইমাম ও তার আত্মীয় নিশিরাতের এমপি শামসুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে আঁতাত করে চলছিল বিধায় ওই সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা হয় নাই।
হারুনের বিরুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন ওই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী তিন নেতা। তারা হলেন এমএ হান্নান, মোতাহার হোসেন পাটোয়ারী ও কাজী রফিক।
মোতাহার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, হারুন সাহেব ফরিদগঞ্জ বিএনপিকে বিভক্ত করেছেন। নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নেই। তাকে ছাড়া আমাদের মধ্য থেকে যাকেই দল মনোনয়ন দেবে, নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধানের শীষকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে আনবে।
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতা। এই আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা ওবায়দুল হক নাসির।
নাসিরের মনোনয়ন পরিবর্তন চেয়ে আবেদনের বিষয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মাইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঘাটাইলে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সে বহিরাগত। তার বাড়ি বাসাইল। ঘাটাইলে দীর্ঘ অনেক বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতন সহ্য করে আমি নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছি, তাদের পাশে থেকেছি।
‘‘আমি ছাড়াও আরও স্থানীয় সিনিয়র নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী। দল আমাদের মূল্যায়ন না করে সেখানে একজন বহিরাগতকে প্রার্থী করেছে। এটা শুধু ধানের শীষ প্রতীককে বিপদ্গ্রস্ত করবে। ভালো ফলাফল আনতে পারবে না।’’
এদিকে, চট্টগ্রাম-১২ আসনের ৬৮০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন। ওই আসনে বিএনপির প্রার্থী এনামুল হক এনামকে পরিবর্তন করে ধানের শীষের প্রার্থী চূড়ান্ত করার আবেদন জানিয়েছেন তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের দুই উপজেলায় বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা লিখিত আবেদন করেছেন। দুই উপজেলা বিএনপির নেতারা লিখিত অভিযোগে বলেছেন, এই আসনে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রার্থী মুশফিকুর রহমান বিগত ১৭ বছর কানাডাপ্রবাসী ছিলেন। নব্বই বছরের বয়োবৃদ্ধ এই নেতা অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। ফলে ধানের শীষের পরাজয় নিশ্চিত।
দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী সাদিক রিয়াজ পিনাক চৌধুরীর বিরুদ্ধে একই আসনের তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি মোজাহারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ কালু এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম আবেদন করেছেন। জামালপুর-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সুলতান মাহমুদ বাবুকে। তার মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে আবেদন জমা পড়েছে। চট্টগ্রাম-১৩ আসনে বয়োবৃদ্ধের অভিযোগে সরওয়ার জামাল নিজামের মনোনয়ন পরিবর্তনের আবেদন করেছেন বঞ্চিত প্রার্থীরা।
এছাড়া সিরাজগঞ্জ-৩ আসনে আইনুল হকের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে তারেক রহমানের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী মেহেদী হাসান রুমীকে পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে দুই উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতারা লিখিত আবেদন করেছেন।
টাঙ্গাইল -৫ (সদর উপজেলা) মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে আবেদন করেছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ফরহাদ ইকবাল। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, টাঙ্গাইল-৫ (সদর উপজেলা) আসনে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে উনি ইতিপূর্বে দুইবার টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূয়াপুর) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। অথচ এবার তাকে সদরে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
‘‘এটা বিএনপির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। তারা চায় সদরের নিজেদের প্রার্থী, কোনো বহিরাগত নয়। নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য দলের হাইকমান্ডের দিকে চেয়ে আছে।’’
তিনি আরও বলেন, আশা করি আমার দলের হাইকমান্ড সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্তে ভুল করলে ধানের শীষের নিশ্চিত বিজয়কে নস্যাৎ করা হবে বলে আমি মনে করি।