সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর পকেটে ঢুকে পড়লে সমস্যা: মির্জা ফখরুল

মির্জা ফখরুল
মির্জা ফখরুল  © সংগৃহীত

জনগণের কাছে অঙ্গীকার করে স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে সংবাদকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিগত সময়ে সাংবাদিকরা দলীয় আচরণ করেছেন অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর পকেটে ঢুকে পড়লে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদমাধ্যম সংস্কার নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।               

সংবাদমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও কর্মীবান্ধব সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় করণীয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি। 

বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা কথা না বলে পারছি না, আপনাদেরসাংবাদিকদের তো অনেকগুলো ইউনিয়ন আছে, বিএফইউজে, বিজেইউজি। আবার দুই দলের দুই ভাগ আছে, তিন ভাগ। নিজেরাইতো আপনারা দলীয় হয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের পকেটে ঢুকতে দিতে চায় না কিন্তু আপনারাই যদি পকেটে ঢুকে যান তখন কিন্তু দ্যাট বিকামস্ অ্যা প্রবলেম।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছিতো গত ১৫ বছরে কি হয়েছে। গত ১৫ বছর আপনারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ফ্যাসিস্টকে সমর্থন করেছেন। এটা আমাদের দেখা, এদেশের মানুষের দেখা। সেই জায়গাগুলোতে আপনাদেরও কমিটমেন্টের প্রয়োজন আছে, আপনারা ওই জায়গাগুলো থেকে নিজেরা বাইরে থাকবেন, আপনাদের কমিটমেন্ট থেকে জনগণের কাছে স্বাধীন সাংবাদিকতা করবেন। 

বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে সংবাদমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনায় নেবে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের কমিটমেন্ট খুব পরিষ্কার, আমার ৩১ দফাতে বলেছি, আমরা একটা স্বাধীন গণমাধ্যম আমরা দেখতে চাই, সেজন্য আমরা তখনই কমিট করেছিলাম একটা কমিশন তৈরি করবো। কমিশন ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, দুঃখের সঙ্গে আমরা জানলাম কমিশনের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে, কিন্তু রিপোর্টটি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি।
আমরা আশা করি যদি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব যদি জনগণের মাধ্যমে পাই তাহলে আমরা নিঃসন্দেহে এটাকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে দেখবো বলে আমার বিশ্বাস করি।

বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলেই সংবাদমাধ্যমের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে দাবি করে দলটির মহাসচিব বলেন, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দেশের সমস্ত পত্রিকাগুলোকে  বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া, সে পত্রিকাগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলছিল। এ অবস্থা থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় এসছেন, তখন তিনি একটা মুক্ত-স্বাধীন সংবাদপত্রের ব্যবস্থা করেছেন। তখন অনেক সংবাদপত্র বেরিয়ে এসেছে এবং মাধ্যমগুলো চালু হয়েছে। আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি, বিএনপি যখনই রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তখনই গণমাধ্যমকে উন্নত করবার জন্য অনেকগুলো ব্যবস্থা নিয়েছে। তারমধ্যে আজকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমরা দেখছি, সেইসময় কিন্তু কাজগুলো শুরু হয়েছিল।

সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে আক্ষেপ করে এ প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, সংস্কার যদি আমরা হৃদয়ে ধারণ না করি, মনের মধ্যে না নেই তাহলে এভাবে সংস্কার কতটুকু সম্ভব হবে আমি জানি না।

এ মত বিনিময় সভায় বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। 

বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক সভায় সভাপতিত্ব করেন। এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সদস্যসচিব ইলিয়াস হোসেন। মত‌বি‌নিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন ক‌রেন বি‌জে‌সির নির্বাহী মিলটন আনোয়ার। বি‌জে‌সির ট্রাস্টিদের ম‌ধ্যে আলোচনায় অংশ নেন তালাত মামুন ও ফা‌হিম আহ‌মেদ। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করে বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন।

বিজেসির আট দফা প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন, একটি স্বাধীন জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন, টিভি চ্যানেলগুলোকে পে-চ্যানেল ঘোষণা করা ও সম্প্রচারমাধ্যমকে শিল্প ঘোষণা এবং সম্প্রচার সাংবাদিকদের জন্য জবাবদিহিমূলক ‘কোড অব এথিকস’ প্রণয়ন; টিভি লাইসেন্স নীতিমালা ও মালিকানার ধরন নির্ধারণ, পরিচালনা পর্ষদে কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মতো কাঠামোগত সংস্কার, স্বাধীন অ্যাক্রেডিটেশন কর্তৃপক্ষ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সাংবাদিকতার নীতিমালার প্রণয়ন ইত্যাদি।

গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশ ও সাংবাদিকদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তায় পড়ে আছে বলেও উদ্বেগ জানিয়েছে বিজেসি।

অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বারবার, বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর বলে আসছে; আপনারা বিগত ১৫ বছরের মত আর কাউকে বিদেশে চলে যেতে হয়, পালাতে হয়, এমন করে আমাদের (রাজনীতিবিদ) তুলে ধরবেন না, তৈরি করবেন না। সেক্ষেত্রে আমাদের যেমন সীমাবদ্ধতা আছে, দুর্বলতা আছে, ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ত্রুটি আছে; সেগুলোকে তুলে ধরে আমাদের শাসন করার দায়িত্ব আপনাদের আছে। জামায়াতে ইসলামী মনে করে, শাসন করার এ দায়ভারটি আপনাদের নিতে হবে অত্যন্ত ন্যায় নিরপেক্ষতার সাথে।

একটু আগে আমাদের সামনে যে কথা শুনেছি, আপনারা আমাদের কেউ হবেন না। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে একটা আহ্বান রাখতে চাই, আপনারা অবশ্যই বাংলাদেশের হবেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সাংবাদিকদের একটা বড় সংকট হলো তাদের সম্মানী, পারিশ্রমিক ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা। আমরা সময় সময় এটা দেখেছি, আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ের যে সাংবাদিকরা আছেন, আমরা যদি জেলা ও উপজেলা শহরের সাংবাদিকদের দিকে তাকাই, তাদের সুর্নিদিষ্ট কোন বেতন কাঠামো নাই। তারা মাস শেষে বেতনটাও পান না। তাদেরকে নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। এই যে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা, সেটাও স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটা ব্যাঘাত তৈরি করে। যদি জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের কোন রাজনৈতিক নেতা বা কোন প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী থেকে তাদের জীবন চালাতে হয়, তাহলে সংবাদ প্রকাশের সময়ও কিন্তু তাদের সেই রাজনৈতিক দল বা নেতা বা সেই যে প্রতিষ্ঠান, তাদের মত করে সংবাদ পরিবেশনের একটা মনস্তাত্বিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই জায়গাটাতে একটা পরিবর্তন দরকার।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য কারা দায়িত্ব পাবেন, বোঝা যায় তো নাকি? আমি জানি না। আপনারা হয়তো বলতে চাইবেন না। আমি বলি, আমার তো মনে হয়, আমি কোনো বিএনপির পক্ষে ক্যাম্পেইন করি না, আমি তো বিএনপি করি না। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক ক্রিটিসিজমের পরও শেষ পর্যন্ত মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে।
 
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতনসহ অনেকে।


সর্বশেষ সংবাদ