‘মানুষের কল্যাণই আমার রাজনীতি’ আজও প্রাসঙ্গিক মাওলানা ভাসানীর আদর্শ
- মাভাবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০০ AM
‘মানুষের কল্যাণই আমার রাজনীতি’ এই এক বাক্যেই সংক্ষেপে ধরা পড়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনের সারমর্ম। বাংলার রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে এমন কিছু নাম আছে যাঁরা সময়কে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁদের আদর্শ, চিন্তা ও ত্যাগ আজও অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জুড়েই ছিল সংগ্রাম, ত্যাগ ও মানবমুক্তির লড়াই। তাই তো তিনি কেবল জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে নয়, সারা বছরই থাকেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। অল্প বয়সেই পিতা-মাতা হারান তিনি। দারিদ্র্য ও কষ্টই তাঁকে শৈশব থেকে জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি করে। মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে আলেম হিসেবে পরিচিতি পান। তাঁর গভীর চিন্তা, সাহসিকতা ও বক্তৃতার জোরে তিনি হয়ে ওঠেন ‘মাওলানা ভাসানী’।
ভাসানীর রাজনীতির মূল মন্ত্র ছিল মানবমুক্তি। তিনি কখনো ক্ষমতা বা পদ লিপ্সার রাজনীতি করেননি; বরং শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন সব জায়গায়ই তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও রয়েছে বিশেষ অবদান, তাই ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি ছিলেন এক ঐক্যের প্রতীক। আর ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিদায়, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল। কাগমারী সম্মেলনের সুবিশাল জনসভায় মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘এভাবেই যদি পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসন-শোষণ চলতে থাকে, তবে আগামী ১০ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি আসসালামু আলাইকুম জানাবে।
সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তিনি রাজনীতিতে থেকেও ছিলেন প্রজাদের মতোই সরল জীবনযাপনকারী। খালি পায়ে হেঁটেছেন গ্রামে, কৃষকের ঘরে খেয়েছেন ভাত-ডাল। জনগণের দুঃখে তিনি কেঁদেছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিনা স্বার্থে। এজন্যই তাঁকে মানুষ ভালোবেসে উপাধি দিয়েছিল ‘মজলুম জননেতা’।
মাওলানা ভাসানী শুধু রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং কৃষক-শ্রমিকের অধিকার রক্ষার প্রতীক। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী এই নেতা সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে যে চেতনা ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশেই ছিল ভাসানীর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফল।
১৯৭৬ সালের ১৭ই নভেম্বর রাত সাড়ে ৮ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সন্তোষে কবর দেয়া হয়। তবে তাঁর মৃত্যু কেবল শারীরিক বিদায়; তাঁর আদর্শ আজও জীবন্ত। প্রতি বছর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশব্যাপী তাঁর স্মরণে নানা আয়োজন হয়। তবে সত্যি বলতে, ভাসানী কোনো নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ নন, তিনি প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
ভাসানী কখনো ক্ষমতা বা পদলিপ্সায় রাজনীতি করেননি; তাঁর সব মনোযোগ ছিল কৃষক, শ্রমিক, গরিব মানুষের মুক্তিতে। এজন্যই সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসে উপাধি দেয় ‘মজলুম জননেতা’।
আজও যখন সমাজে অন্যায়, বৈষম্য ও দুর্নীতি দেখা দেয়, তখন ভাসানীর নাম ফিরে আসে আলোচনায়। তাঁর দর্শন, সাহস ও মানবিকতার রাজনীতি নতুন প্রজন্মকে শেখায় ‘রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয়, মানুষের কল্যাণ।’
তাই তো মাওলানা ভাসানী আজও বেঁচে আছেন বাংলার প্রতিটি মানুষে, প্রতিটি আন্দোলনে, প্রতিটি প্রতিবাদে।