জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ বিএনপি

বিএনপির লোগো
বিএনপির লোগো   © সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ক্ষমতার বাইরে থেকে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বারবার নিজেদের সমর্থন জানিয়ে আসছে। রাজনীতিসহ বিভিন্ন খাতে দ্রুত কিছু সংস্কার করে দেশে একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি সরকারকে সব সময় সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ বা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর থেকেই কমিশনের সুপারিশমালা ও কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে সরকারের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

বুধবার (২৯ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে নিজের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) ঐকমত্য কমিশন তাদের রিকমেন্ডশন্স দিয়ে দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। প্রধান উপদেষ্টার সইও আছে সেখানে, তিনিও এটার চেয়ারম্যান বোধ হয়, কো-চেয়ারম্যান। তো এখন অবাক বিস্ময়ে আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, আমরা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে যে বিষয়গুলোর সঙ্গে আমরা একমত ছিলাম না, সেখানে আমরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম। সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন)। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা লক্ষ করলাম, কালকে যখন তারা এটা প্রকাশ করেছে, সেগুলো (বিএনপির দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট) নেই। নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি ইগনোর করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। কারণ ঐকমত্য কমিশন করা হয়েছিল কেন? এই ঐকমত্য কমিশন, এটা আমি বলব, জগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা এবং এটা অবিলম্বে বিষয়গুলো সংশোধন করা দরকার বলে আমি মনে করি।’

জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে ও সর্বজনীন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপত মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা , পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্যবিষয়ক, মহিলাবিষয়ক, শ্রম অধিকার এবং গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য কমিশন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে চারটি কমিশন চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারী প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

আরও পড়ুন: ক্লাস শুরুর দাবিতে অনশনে প্রস্তাবিত সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা

এর মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও মানুষের আগ্রহের বিষয় ছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আর সেই ঐকমত্য কমিশন যেসব সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের কাছে জমা দিয়েছে তাতে চরম ক্ষুব্ধ ও নাখোশ বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারণী মহলের সদস্যরা বলেছেন, এটি ঐক্যের বদলে জাতীয় অনৈক্য তৈরির চেষ্টা বলেই মনে হয়েছে। 

কমিশন তাদের সুপারিশে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের প্রস্তাব করেছে। কমিশনের এই প্রস্তাবকে অবান্তর সুপারিশ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এ প্রস্তাব কমিশনের হতে পারে না। বিএনপি কমিশনের এই প্রস্তাবের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নয়। আমাদের (বিএনপি) অবস্থান হলো গণভোট এবং নির্বাচন একই দিনে দুটি আলাদা ব্যালটের মাধ্যমে হবে। নতুন করে জুলাই সনদ সামনে আনার সুযোগ নেই।’

খসরু আরও বলেন, ‘এ নিয়ে (গণভোট) আলাপ-আলোচনারও সুযোগ নেই। জাতীয় নির্বাচনের দিন দুটি আলাদা ব্যালটের মাধ্যমে গণভোট হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটি বিএনপির প্রথম দিন থেকেই অবস্থান, যা এখনো অপরিবর্তিত। ভবিষ্যতেও পরিবর্তন হবে না।’

এদিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সুপারিশের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। কমিশনকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি? অবশেষে তারা তাদের প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পেরেছেন।’

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘দ্বিতীয়বার তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয়, যা কিছু প্রস্তাব ওখানে দেওয়া হয়েছে, আপনারা যদি সেটা দেখেন, তাহলে দেখবেন আমরা যে জুলাই জাতীয় সনদ সই করেছি, সেই সনদবহির্ভূত অনেক আদেশ এতে সংযুক্ত করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন: পে কমিশনের সঙ্গে বসছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা, থাকছেন যেসব শিক্ষক

তিনি বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদে সম্ভবত ৮৪টি দফা। বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্ন মত আছে, নোট অব ডিসেন্ট আছে। পরিষ্কারভাবে সেখানে উল্লেখ করা আছে, নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো যে রাজনৈতিক দলগুলো দিয়েছে, তারা যদি নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয় তাহলে তারা সেভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবে। অথচ বিস্ময়করভাবে যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সঙ্গে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নেই।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার জন্য দলীয়ভাবে বিএনপির টিমের নেতৃত্বে ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। 
বুধবার রাজধানীতে একটি হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে সালাহউদ্দিন আহমদ কমিশন নিয়ে নিজেদের চরম হতাশার কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপি হতাশ। কমিশন ও সরকারের পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে বিএনপির প্রত্যাশা মিলে না।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘গত ১৭ তারিখ যে দলিল স্বাক্ষর হয়েছে, সেই বিষয়গুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বলা হলো ৪৮টি দফার ওপর গণভোট করা হবে কিন্তু আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। তবে, এতদিন কেন এত আলোচনা, এত কসরত করা হলো, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ।’

তিনি বলেন, ‘যেগুলো ঐকমত্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। জুলাই সনদ যেটা স্বাক্ষর হয়েছে সেটা নেই। আছে কমিশন ও দুই-একটি দল যে প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু যা প্রস্তাব এসেছে, তাতে জাতিতে বিভক্তি ও অনৈক্য সৃষ্টি হবে, কোনো ঐকমত্য হবে না। তাদের উদ্দেশ্য আমরা জানি না, তারা কী অর্জন করতে চায় তা আমরা জানি না।’

আরও পড়ুন: ১:৫ অনুপাতে সর্বনিম্ন বেতন ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব

সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা রাখবে, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে কাজ করবে বলে আমরা আশা করি। আমরা ঐকমত্য কমিশন এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হতাশা প্রকাশ করছি।’

কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জনগণ ও রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রতারণার অভিযোগের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আপনি কিন্তু জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ যে আপনি এখানে সত্যিকার অর্থে যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেবেন সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সেই পার্লামেন্ট এই দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করবে। সুতরাং আজকে যদি এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে, এর থেকে বাইরে যদি যান, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে। এই কথাটা আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই। আমি আশা করব, তাদের (অন্তর্বর্তী  সরকার) উপলব্ধি আসবে এবং অতি দ্রুত এই সংস্কার কমিশনে সব দল যেগুলোর মধ্যে আমরা একমত হয়েছি এবং যেগুলো দ্বিমত পোষণ করেছি, সব কিছুকে নিয়ে একটা নির্বাচন আপনি অবিলম্বে দেবেন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটা জনগণের একটা পার্লামেন্ট তৈরি করতে পারব। একটা জনগণের শাসন আমরা দেশে নিয়ে আসতে পারব।’


সর্বশেষ সংবাদ