সংস্কার নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ভিন্ন মত, ঐকমত্য কীভাবে?

সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক
সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক  © সংগৃহীত

নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে যে একধরনের দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস বাড়ছিল, লন্ডন বৈঠকের পর আপাতত তার অবসান হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এরপরও নির্বাচনের আগে বেশ কিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আছে রাজনীতিতে। বিশেষ করে সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যু, সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়ের কথা জানাচ্ছে জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল। এসব ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গেও মতপার্থক্য তীব্র হয়েছে।

দলগুলোর সঙ্গে যখন ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক বৈঠক চলছে, তখনো এসব মতপার্থক্য জোরালো হয়ে সামনে এসেছে। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের লক্ষ্য ঐকমত্য তৈরি করা। ১৬৬ প্রস্তাব আছে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলোর সবগুলোতে সব দল একমত হবে এমনটা সম্ভব নয়। এখন আমরা আশা করছি মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত হতে। একটা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ক্ষমতা যেন এককেন্দ্রিক না হয়, সেগুলোকে মাথায় রেখে যতদূর পর্যন্ত ঐক্য হবে, সেটাই আসলে জাতীয় ঐকমত্য।’

তবে সংস্কারের বাইরেও বিভিন্ন ইস্যু আছে, যেগুলো নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

ঐকমত্য কীভাবে হবে?
রাজনৈতিক দলগুলো দফায় দফায় বৈঠকে বসে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের মতো বহু বিষয়ে একমত হলেও সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য তীব্র হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ গঠন, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ মৌলিক বিষয়গুলোতেই মতপার্থক্য বেশি দেখা যাচ্ছে। এই মতপার্থক্যগুলো আগে থেকেই দলগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়।

একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না-ঐকমত্য কমিশনের এমন প্রস্তাব অধিকাংশ দল সমর্থন করলেও বিএনপি ভিন্ন কথা বলছে। দল এমন একটি প্রস্তাব দিচ্ছে যার ফলে দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একটা বিরতি দিয়ে প্রয়োজনে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী সুযোগ থাকছে।

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা প্রথম, বাংলাদেশের অবস্থান কত?

একই ব্যক্তির একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, এমন প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দুইবারের বেশি (প্রধানমন্ত্রী) আপনি করতে পারবেন না। কিন্তু গ্যাপ দিয়ে যদি এ রকম পরিস্থিতি কখনো হয় যে জনগণ চাচ্ছে, তখন তো হতেই পারে। আপনাকে তো জনগণের অপশনও চিন্তা করতে হবে।’

একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধানের পদে থাকাটাও সমস্যা মনে করেন না তিনি।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একজন ব্যক্তি দলীয় প্রধান ছিলেন বলেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে দলের কার্যক্রমে থাকবেন না। দলের রাজনীতি করেই তো তিনি এতদূর এসেছেন। দল পরিচালনাও তো গুরুত্বপূর্ণ।

তবে এতে করে দেশের রাজনীতি এবং ক্ষমতা একব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যেতে পারে এমন আশংকা থেকে বিরোধিতা করছে বিভিন্ন দল।

‘প্রধানমন্ত্রী এমন একটা পদ যেখানে লং টাইম থাকলে বা একইব্যক্তি বারবার আসতে থাকলে এখানে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে এতো আন্দোলন, রক্ত ঝরানো -এগুলোর যে স্পিরিট তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এতে করে কর্তৃত্ববাদ আবার ফিরে আসতে পারে’ বলেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।

সংবিধান এবং সংস্কার বাস্তবায়ন প্রশ্নেও বিরোধ
বিভক্তি আরও আছে। সেটা হচ্ছে, সংস্কার কখন এবং কীভাবে বাস্তবায়ন হবে। এ ক্ষেত্রে এনসিপি এবং জামায়াত চায় নির্বাচনের আগেই সংস্কার কার্যকর হোক।

জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, তার ভাষায়, সংস্কার নির্বাচনের আগে না করে রেখে দিলে পরে এর বাস্তবায়ন ঝুলে যেতে পারে।

তিনি বলেন, সবাই একসঙ্গে যদি আমরা সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য হই, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করতে সমস্যা কোথায়? আমরা সবাই মিলে জুলাই সনদ অনুমোদন হবার পর এর বাস্তবায়ন পরবর্তী সংসদ না হলে করা যাবে না, এর তো কোনো যৌক্তিকতা নেই।

আরও পড়ুন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি গঠনে আসছে নীতিমালা

অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসাইন বলেন, সংস্কার নির্বাচনের আগেই হতে হবে।এগুলো অধ্যাদেশ জারি করেও করা যায়। মূলকথা এসব বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনের আগেই যে কাঙ্খিত পরিবর্তন, সেগুলো দৃশ্যমান হবে না।

এ ছাড়া সংবিধান নতুন করে লেখা হবে নাকি সংশোধন হবে, তা নিয়েও ভিন্নমত আছে। এনসিপি নতুন সংবিধানের পক্ষে থাকলেও বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য অনেক দল মনে করে সংবিধান সংশোধনই যথেষ্ট।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসাইন বলেন, তার ভাষায়, সংবিধান সংশোধন করলে ভবিষ্যতে সেটা চ্যালেঞ্জ করে বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ থেকে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার এর আগে এভাবেই সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধনী বাতিল করেছে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানও বাতিলে করেছে। সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের মতো বিষয়গুলোও বাতিল করা হয়েছে।

‘এই সুযোগটা থেকেই যাবে। নতুন সংবিধান না হয়ে ঘষামাজার সংবিধান হলে আমরা মৌলিক পরিবর্তনগুলো আনতে পারবো না। সংবিধানের পরিবর্তন হলেও সেটাকে স্থায়ী করা যাবে না। সেটা বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে’ বলেন আখতার হোসাইন।

ঐকমত্য না হলে কী হবে?
দলগুলোর মধ্যে সংস্কার নিয়ে নানা বিভক্তির মধ্যেই ১৬৬টি ইস্যুতে ঐকমত্য কমিশন ধারাবাহিক বৈঠক করছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই সংস্কার চূড়ান্ত করে জুলাই সনদ হতে হবে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যেগুলো ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই এগোতে হবে।

বিএনপির এই নেতার বক্তব্য হচ্ছে, ‘সবাই তো সব বিষয়ে একমত হবে না। যেগুলোতে বিরোধিতা থাকবে, সেগুলো নিয়ে তো আমরা কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারিনা। একমতের ইস্যুগুলো নিয়ে এগিয়ে যাব। আর যেগুলো নিয়ে বিরোধীতা আছে, সেগুলো নিয়ে দলগুলো নির্বাচনের মাঠে জনগণের কাছে সমর্থন চাইতে পারে। জনগণ যদি তাদের ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে তারা নির্বাচিত হয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করুক।’

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি থেকে ১৪ কার্গো বিমানে অস্ত্র এলো ইসরায়েলে

তবে বিএনপি যেটা বলছে, তাতে করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ গঠন, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ গুরুত্বপুর্ণ এবং মৌলিক বিষয়গুলো বাদ পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় এনসিপিসহ বিভিন্ন দল এর বিরোধিতা করছে।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘মৌলিক বিষয়ে সংস্কার হলে তখনই তার দল জুলাই সনদের দলিলকে সমর্থন করবে। মৌলিক বিষয়ে সংস্কার হলেই আমরা এই দলিলকে সমর্থন করবো বা এই প্রক্রিয়ায় যাবো। তখন আমাদের কোনো ছাড় দিতে হলে সেটা আমরা চিন্তা-ভাবনা করবো। কিন্তু মৌলিক বিষয় ছাড়া অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যদি ঐকমত্য হয়, তাহলে সেটা আমাদের শাসন ব্যবস্থার বা রাষ্ট্রকাঠামোর কোনো পরিবর্তন হবে না। সেটাকে আমরা মৌলিক সংস্কার হিসেবে বিবেচনা করব না।’

এমন অবস্থায় সমাধান হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।

দলটির নেতা হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘যে ইস্যুতে ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে সনদ হোক। কিন্তু যেগুলো নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে, সেগুলো তো ফেলে রাখলে হবে না। এটা দেশের জন্য অন্য ধরণের ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, ঝুঁকির মুখে দেশকে ফেলতে পারে। কারণ এগুলো মৌলিক বিষয়। এগুলো সেটেল হতেই হবে।’

কিন্তু সেটেল কীভাবে হবে এমন প্রশ্নে গণভোটের কথা বলেন জামায়াতের এই নেতা।

‘এটা তখন গণভোটে দিতে হবে। গণভোটে দিলে তখন জনগনের রায়ের ভিত্তিতে এটা সেটেল করা যাবে। জনগণ যার প্রস্তাবকে সমর্থন করবে, সেটা জুলাই সনদের জন্য গ্রহণ করা যাবে।’

তবে মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া নিয়ে আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।

তিনি বলেছেন, কমিশন কাউকে বাধ্য করতে পারবে না। কিন্তু ঐকমত্য তৈরি হবে, এমনটাই তার আশা।

আরও পড়ুন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বান্ধবীকে শার্ট-ক্যাপ পরিয়ে শিক্ষার্থীর রাত্রিযাপন

আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আশা করছি, মৌলিক বিষয়গুলোয় একমত হতে। একটা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ক্ষমতা যেন এককেন্দ্রিক না হয়, সেগুলোকে মাথায় রেখে যতদূর পর্যন্ত ঐক্য হবে, সেটাই আসলে জাতীয় ঐকমত্য। আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারবো না। কিন্তু দলগুলো কিছুটা ছাড় দিলেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব ‘

তবে একদিকে সংস্কার, এর বাস্তবায়ন নিয়ে বিভক্তি, অন্যদিকে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রথমে বিএনপি আর এখন জামায়াতসহ কয়েকটি দলের সংশয় প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভবিষ্যত নিয়ে। নির্বাচনের আগে এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
খবর বিবিসি বাংলার


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!