বিবিসি সাংবাদিকের কান্না
ট্রাম্প বললেন তেহরান ছাড়ো, বাবা-মা বললেন— ‘নিজের ঘরেই সম্মানের সঙ্গে মরতে চাই’
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০৯:৩০ AM , আপডেট: ২০ জুন ২০২৫, ০৮:৩৫ PM

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যেই ইরানের রাজধানী তেহরান ছাড়তে দেশটির নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। বেসামরিক নাগরিকদের বড় একটি অংশ শারীরিক অসুস্থতা, আবেগিক বন্ধন এবং নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শহর ছাড়তে পারছেন না। এমন বাস্তবতা তুলে ধরে বিবিসির একজন ইরানি সাংবাদিক লিখেছেন তার নিজের জীবনের গল্প।
ওই সাংবাদিক জানান, তেহরানে চলমান উত্তেজনা ও সংঘাতের মুখে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরান ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানান, তখন তিনি নিজেও চেয়েছিলেন তার বাবা-মাকে রাজধানী থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে। কিন্তু তার বাবা সাফ জানিয়ে দেন, এই বয়সে আমাদের নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা রয়েছে। যানজট পেরিয়ে জনাকীর্ণ শহরে গিয়ে মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করে বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তেহরান ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তার মা ভুগছেন ভার্টিগোতে, যা তাকে কার্যত ঘরবন্দি করে ফেলেছে। চলাফেরার জন্য তার প্রয়োজন হয় অন্যের সহায়তা। বাবাও দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত। একটানা দশ মিটারের বেশি হাঁটতে পারেন না, মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশে থেমে বিশ্রাম নিয়ে তবেই সামান্য এগোতে পারেন।
আরও পড়ুন: ইসরায়েলের চ্যানেল ১৪ কার্যালয় খালি করতে ইরানের হুঁশিয়ারি
তবে এই সাংবাদিকের পরিবার ব্যতিক্রম নয়। একই অভিজ্ঞতা রয়েছে আরও অনেকের। এক নারী বাসিন্দা জানান, তার বাবা-মাও অন্যত্র যেতে চান না। তাদের বিশ্বাস, নিজের ঘরেই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু হওয়া ভালো। তারা মেয়ে-ছেলেকে জানিয়েছেন, যদি আমাদের বাড়ি ধ্বংস হয়, আমরা তার সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতে চাই।
একজন বাসিন্দা জানান, তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছেন কেউ আলঝেইমার্সে আক্রান্ত, কেউ হুইলচেয়ারে নির্ভরশীল। এ ধরনের মানুষদের স্থানান্তর প্রায় অসম্ভব। তাই পরিস্থিতির দুঃসহতা নিয়েই থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
রাজধানী তেহরানের চিত্রও ভয়াবহ। শহরের অধিকাংশ এটিএম মেশিন খালি, দোকানপাট বন্ধ, অনেক ভবনে নেই পানির সরবরাহ। কেউ কেউ জানান, সংঘাত শুরু হওয়ার সময়ই পানির পাইপ ফেটে যায়, এখনো তা সারানো হয়নি। একজন বাসিন্দা বলেন, বাচ্চাদের আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা রয়ে গেছি— বাড়ি, পোষা প্রাণী ও রাস্তার বেড়ালগুলোর কথা ভেবে। ঈশ্বর চাইলে এই সংঘর্ষ থেমে যাবে।
তেহরানের রাস্তায় থাকা অসংখ্য বেড়াল শহরেরই একটি পরিচিতি। এখানকার একটি বিখ্যাত ক্যাট মিউজিয়াম ও ক্যাফে ‘মিয়াওজিয়াম’-ও এই মানবিক টানাপড়েনের অংশ। বাসিন্দারা জানান, শহর ছেড়ে গেলে এসব প্রাণী ও সম্পত্তির দেখভাল করার কেউ থাকবে না।
আরও পড়ুন: ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল ক্লাস্টার মিউনিশন: ধারণা ইসরায়েলের
অন্যদিকে যারা শহর ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের সামনে তীব্র যানজট বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেহরানের জনসংখ্যা ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। ফলে রাজধানী ছাড়তে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ যানজট। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি তেল বরাদ্দ সীমিত থাকায় অনেকেই রাস্তায় আটকে পড়ছেন। কেউ এসি চালাতে পারছেন না প্রচণ্ড গরমে, কেউ মাঝপথে তেল ফুরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পেট্রোলপাম্পে কয়েক কিলোমিটার লম্বা লাইন, অনেকে কয়েক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় নিচ্ছেন ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি।
যারা শেষপর্যন্ত কোনোভাবে গন্তব্যে পৌঁছেছেন, তাদের সামনে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ— পর্যাপ্ত বাসস্থান নেই, বাড়ি ভাড়া আকাশছোঁয়া, খাবারের দাম অস্বাভাবিক। এমনকি গাড়ি ভাড়াও অনেকের সাধ্যের বাইরে।
এক তেহরানবাসী বলেন, ‘বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র— কেউই আমাদের নিয়ে ভাবে না। আরেক নারী বলেন, আমরা এখন এক নিষ্ঠুর শাসনের ভেতর আটকে আছি, যারা জনগণের নিরাপত্তা বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না। অন্যদিকে যারা হামলা চালাচ্ছে, তারাও মানবিকতা বিবর্জিত। এই দুইয়ের মাঝে আমরা কেবল কষ্ট পাওয়ার জন্য পড়ে রয়েছি।’
তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন— বিশ্বের অন্য প্রান্তে বসে আপনি যখন বলেন ‘তেহরান ছেড়ে চলে যান’, তখন কি আপনি আমাদের মৃত্যুই কামনা করছেন? যেন বলার সুযোগ পান, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম’?