আত্মহত্যা আপনার জন্য কতটা জরুরি?

লেখক
লেখক  © টিডিসি ফটো

এক. করোনা তথা বিশ্বব্যাপী মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে সচেতনতা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে লকডাউনে আমরা ঘরবন্ধি থাকতে এক প্রকার বাধ্যই ছিলাম বহুদিন ধরে,এমন কি সে রেশ এখনও ভালভাবে কাটেনি। ফলে আমাদের একাকিত্ব, সঙ্গহীন সময় পাড় করা, জীবনের এক ঘেয়েমি অথবা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় আমাদের ব্যবসা বা ক্যারিয়ার নিয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে যাচ্ছি এবং এটা হওয়াই বর্তমান বাস্তবতায় খুবই স্বাভাবিক।তবে উদ্বেগের বিষয় হলো এই হতাশা ও এক ঘেয়েমি থেকে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন এবং আরও ভয়ানক তথ্য হলো এই প্রবণতা শিক্ষিত তরুণ সমাজে বেশি লক্ষণীয়।

সম্প্রতি প্রথম সারির গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই প্রকাশ পেয়েছে। তারা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণার বরাত দিয়ে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি।

দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংখ্যাটি পেয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। আঁচলের হিসাবে, ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অর্নাস কলেজের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছেন।

আঁচলের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ৩ জন আত্মহত্যা করেছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ প্রথম আলোকে বলেন, দুটি জাতীয় দৈনিকের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই তথ্য ভয়ানকভাবে  আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানকেই তুলে ধরছে।


এই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বাইরেও যারা আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক,ডাক্তার,অভিনেতা,বিসিএস ক্যাডার,পুলিশ সদস্য ও ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার নানা বয়সের মানুষ। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও চিত্রনায়ক রিয়াজের শশুর ফেইসবুক লাইভে তার মানসিক অবস্থা ব্যাখ্যা করে নিজ পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন সম্প্রতি।বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এছাড়াও লকডাউনে ঘরবন্ধি হয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে এবং ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে রিক্সাচালক,দিন মজুর নিজের ঘরেই রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন, পারিবারিক কলহের কারণে নিজ আগ্নেয়াস্ত্রে জীবন দিয়েছেন এক পুলিশ সদস্য,আর্থিক অনটনের বোজা বইতে না পেরে একই ভাবে সম্প্রতি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন আরেকজন বিজিবি সদস্য।এমন আরও বহু সংবাদ আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ  মাধ্যম গুলোতে।সম্প্রতি পারিবারিক কলহের জেরে সদ্য বিসিএস ক্যাডারের মত দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চাকুরিতে  নিয়োগ পাওয়া একজন নারী কর্মকর্তাও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন।অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই হার কম নয় বরং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।এই খবর শুধু আমাদের দেশের ভেতরেই নয় সম্প্রতি আমেরিকায় বসবাসরত এক বাঙালি পরিবারে দুই ভাই নিজ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে নিজেরা সেই অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।আরও মারাত্মক ও উদ্বগের খবর হলো স্কুল পড়ুয়া শিশুদের মধ্যেও সম্প্রতি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে অনলাইন গেইমস খেলার টাকা না পেয়ে অথবা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলকে কেন্দ্র করেও এই প্রবণতা শিশু কিশোরদের মধ্যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক বা পত্রিকার পাতা খুললেই অন্তত একটি আত্মহত্যার খবর আমাদের চোখের সামনে আসে। তবে কি আত্মহননের পথই কি 'মুক্তির' পথ,এটাই কি 'সমাধানের' একমাত্র উপায়?

দুই. প্রত্যেকটি আত্মহত্যার পেছনের গল্প থেকে যে সত্যটি প্রতীয়মাণ হচ্ছে তা হলো, আমরা যে মনোজাগতিক পৃথিবীতে বসবাস করছি সেই পৃথিবীটা ধীরে ধীরে যেন সংকীর্ণ হয়ে আসছে।মানুষের সংখ্যা বাড়লেও মানুষ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ।যদিও এই পৃথিবীটা তো সেই পৃথিবীরই একটা অংশ যে পৃথিবীর অংশ আপনার আমার পরিবার, সমাজ, দেশ,বন্ধু-বান্ধব অথবা প্রিয় মানুষটিও অথচ অবাক করার বিষয় হলো সেই পৃথিবীর পরিবেশ এখন আর বাস যোগ্য নয় আপনার কাছে,একটা মুহূর্ত সামনে এগোবার ধৈর্য নেই আর।মনের অজান্তেই আবৃত্তি হচ্ছে মানুষ নামে অমানুষে ভরে গেছে চারিপাশ,প্রতিনিয়ত বিষাক্ত করছে নিঃশ্বাস নেবার বাতাস টুকুও।বিশ্বাস নামক বিমূর্ত বিষয়টিও কাচের মত ভেঙে গেছে বার বার,সফলতার দ্বার প্রান্তে গিয়েও ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।লজ্জায় ঘৃণায় যে কথা কাউকেই বলা যাচ্ছে না,সহ্য করা যাচ্ছে না,আর্থ-সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক শাসন, অন্যায়-অবিচার,বেকারত্ব, পারিবারিক কলহে জীবন হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়। তাই হয়তো আপন মনে আবৃত্তি হচ্ছে আর কেন বসে থাকা,আরেক মুহূর্ত দেরি নয় সময় অপচয় করবার; অতএব যা কয়েকদিন ধরেই মনে মনে ভাবছেন কিন্তু সময় ও সাহস করে উঠতে পারেননি ঠিক তখনই হয়তো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন স্বেচ্ছায় পৃথিবী ছাড়ার।যে কথাটি কে আমরা 'আত্মহত্যা' নামে বুঝে থাকি।

'আত্মহত্যা' প্রত্যয়টি বিভিন্ন সমাজে যে নামেই পরিচিতি পাক না কেন তা আগেও ছিল আর এখনো আছে এবং হার কমুক আর বাড়ুক ভবিষ্যতেও থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন দেশে এই কর্মটি কে নিয়ে রয়েছে নানা রকম হাস্যকর আইন।এ আইনের কথা শুনলে ভুক্ত ভোগী ব্যক্তিকে অন্তত মরার আগে অনেক দুঃখেও একবার শেষ হাসি হাসবার ইচ্ছে জাগাতে পাড়ে।কারণ, কেউ মনের সুখে বা শখে, আইন কানুনের শাস্তির ভয় চিন্তা করে আত্মহত্যা করে না বা করবে না অথচ তাকেই আইন করে ভয় দেখানো হচ্ছে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা ঘটনা ঘটার আগে ধরা পড়লে এক বছরের কারাদণ্ড, অর্থ দণ্ড বা উভয় দন্ড ইত্যাদি ইত্যাদি (তথ্যসূত্র:বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যা করতে গিয়ে না মরলে আত্মহত্যার অপচেষ্টা করার কারণে ব্যক্তির ১ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।)

অথচ ভেবে  দেখুন,যে মানুষ সারাজীবন নরকে থাকার ভয় কে জয় করেছে,প্রিয় মানুষের ভালবাসা ফেলে যেতে পিছপা হয়নি  তাকেই কি না তিনবেলা খাবার দিয়ে একবছর জেলে রাখবার ভয় দেখাচ্ছি অথবা প্রিয়জন থেকে দূরে রাখবার ভয় দেখাচ্ছি আমরা আইন করে কিন্ত তার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনের কারন জানার চেষ্টা করছি না বা এর থেকে পরিত্রাণের পথও ভাবছি না কেউ, শুধু তার মৃত্যুর পর কখনো তিরস্কার বা আফসোসের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করছি আমাদের প্রিয়জন হারানোর অনুভূতি। তবে  সীমিতাকারে আত্মহত্যার অধিকার নিয়েও আজকাল বহু সংগঠনের কাজ করতে দেখা যায়। তাই দিন দিন 'আত্মহত্যা' বিষয়টি আমাদের কাছে আরও পরিচিত প্রত্যয় হিসেবে স্পষ্ট হচ্ছে।

তিন. কারা আত্মহত্যা করছেন বা যারা আত্মহত্যা করেন তারা কি সবাই বোকা,দূর্বল বা অশিক্ষিত? না,বিষয় টা এমনও নয়।আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এমন তালিকায় এমন অনেক ব্যক্তিকেই পাওয়া যায়,যারা শুধু শিক্ষিত বা মেধাবীই নন বরং তাদের শিক্ষা ও মেধার মান আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত।

কথিত আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত খলনায়ক নামে পরিচিত সাহসী হিটলারও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিছুদিন আগেই দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানী গুডাল স্বেচ্ছায় ঘটা করে সবার সম্মতি নিয়ে ক্লিনিক্যাল সুইসাইড করলেন।অনেকের ধারণা, ট্রাম দূর্ঘটনা নয় রুপসী বাংলা কবি খ্যাত জীবনানন্দ দাস জীবনের হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছিলেন। এমন আরো বহু উদাহরণ দেখা যায় ধৈর্যের উপন্যাস লেখক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট হেমিং ওয়ে,নৃবিজ্ঞানী আলথুসার এর মত বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি।এছাড়াও ভারতের কৃষক-শ্রমিক, জাপানিদের সংঘবদ্ধ ভাবে হারিকিরি করে আত্মহত্যার কথাও শোনা যায়।

তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়,যে কেউই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে তার জীবন বাস্তবতার এক ভয়ানক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।পাগল থেকে সুস্থ্য মস্তিষ্কের,শিক্ষিত-অশিক্ষিত,শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং ভীতু থেকে সাহসী, নারী-পুরুষ, জাতি,ধর্ম,বর্ণ,গোত্র নির্বিশেষে সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বা সমাজে এ পথে হেটেছেন বা এখনও হাটছেন। এই মানসিক রোগ বা বাস্তবতা থেকে কেউই যেন মুক্ত নন।

চার. আমাদের জল্পনা কল্পনা শেষে এখন একটাই প্রশ্ন আর তা হচ্ছে কোন পর্যায়ে গেলে সেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে।বিষয়টি যে অবশ্যই আপেক্ষিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ অপমানে,কেউ আবেগে,কেউ বার বার পরীক্ষায় বা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে,বেকারত্বের অবসান ঘটাতে, কেউ ঋণের দায় এড়াতে,কেউবা আবার রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অথবা কেউ পারিবারিক কলহের যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে এমন কি শত্রুর হাতে ধরা না পরার কৌশল হিসেবেও এই ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যুদ্ধের কৌশল হিসেবে।আবার হাদিস কুরআন না বুঝে, না পড়ে মিথ্যে ইমানি দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও নিরীহ মানুষ মারার জন্য জঙ্গিবাদের মত সুইসাইড স্কোয়াডে যোগ দিয়েও আত্মহত্যা করে থাকেন।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তার "সুইসাইড" গ্রন্থে ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও স্পেনের আত্মহত্যার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে হত্যার হার ও সামাজিক কার্যকারণ অনুসন্ধান করেন।সে সময়ে আত্মহত্যা সম্পর্কিত প্রচলিত কিছু মত ছিল এমন মানুষ আত্মহত্যা করে জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ,তাপমাত্রার প্রভাব কিংবা অনুকরণ প্রিয়তা থেকে।সেগুলোকে বাদ দিয়ে তিনি আত্মহত্যার পেছনে লিঙ্গ, বিবাহ, ধর্ম, বসবাসের অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক নৈরাজ্যকে সামনে আনেন। তার তত্ত্বে কিছু স্বতঃসিদ্ধ ছিল এমন,নারীর চেয়ে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি অবিবাহিতদের তুলনায় বিবাহিতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কম বিবাহিতদের তুলনায় বিধবা-সিঙ্গেলদের আত্মহত্যার হার বেশি।এ স্বতঃসিদ্ধগুলোর সঙ্গে ডুর্খেইম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নৈরাজ্য বা সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে যুক্ত করেন।(তথ্যসূত্রঃসুইসাইড:ইমেইল ডুর্খেইম)

আবার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আচল ফাউন্ডেশনের  গবেষণা মতে, শিক্ষার্থী আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি।

দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংখ্যাটি পেয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন।

আঁচলের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত বছর আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন বা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, যা মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩।’

তাদের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ২৭ জন।

আঁচলের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, গত বছর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৬৫ জন ছাত্র, অর্থাৎ আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশই ছাত্র। ছাত্রীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র গত বছর আত্মহত্যা করেছেন।

করোনাকালে সারা দেশেই বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আঁচল বলছে, আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান—এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

আমরা যত গবেষণাই করি না কেন সামাজিক,ভৌগোলিক,মানসিক,কাজ কর্ম ও পরিবেশের ভিন্নতায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে ।

পাঁচ. জৈব বিবর্তনের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বের মূলকথা ছিল দূর্বল প্রজাতির প্রাণীরা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়,যোগ্যরাই টিকে থাকে।(তথ্যসূত্র-অরিজিন অব স্পিশিস:চার্লস ডারউইন) 

প্রতিকূলতারর মাঝে টিকে থাকা,নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা।আর এই টিকে থাকাটা কারো দান নয়,নিজের যোগ্যতা।নৃবিজ্ঞানীরা এটাকে বলেন সার্ভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট। আপনি টিকে আছেন বলেই মাঝরাতে ভাঙা  হাতের ব্যাথাটা অনুভব করছেন কিন্ত একবারও কি ভেবেছেন আপনার অস্তিত্ব না থাকলে আপনার গুরুত্ব কতখানি?

আমরা মানুষের ক্ষমতা,দাপট,শিক্ষা দীক্ষা,চিকিৎসা, সাফল্য বা ব্যর্থতা ইত্যাদি তার অস্তিত্ব থাকা সাপেক্ষ চিন্তা করি কিন্ত যে বেচে নেই বা আজ মারা গেল তাকে কিন্ত সিলেবাসের বাইরে রাখছি আজ থেকেই।এই যে এত রাজনীতি,সমাজনীতি, প্রিয়ার ভালবাসা বা পরিবারের মায়া মমতা আজ থেকেই সব বন্ধ।এত নাম-ধাম,খ্যাতি-কুখ্যাতি সব শুধুই সাময়িক চিন্তার স্মৃতি নামক যন্ত্রের খোরাক মাত্র।আপনার প্রিয় মানুষটিও হয়তো সংসার ধর্মে ডুবে আছে স্বামীর ভালবাসার প্রিয় মানুষ হয়ে অথবা স্ত্রীর দায়িত্বশীল আদর্শ স্বামী হয়ে অথচ আপনি হয়তো তার জন্য ইদুর মারার ঔষধ খেয়ে দিব্যি পৃথিবীকে বিষাক্ত আখ্যা দিয়ে বিদায় জানিয়েছেন বা জানাতে চাইছেন।আরও অবাক হওয়ার বিষয় হলো, প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে যে ছেলে বা মেয়েটির জন্য জীবন দিতে চলেছেন তার সাথে আপনার পরিচয় ছয় মাস, দুবছর বা পাচ বছর আগে থেকে আর তার জন্যই এতদিন আগলে রাখা, যত্নে গড়া জীবনকে ঠেলে দিতে চাইছেন সারাজীবনের জন্য এই পৃথিবী ছেড়ে নরকের পথে অথচ দু,চার,পাচ বছর আগে হয়তো তার নামও শুনেননি।

মজার বিষয় হলো,যে পর্যন্ত আপনি বেচে আছেন সে পর্যন্তই পৃথিবীর সব কিছু করার বা হওয়ার সম্ভাবনা রাখেন আপনি।হাজার হাজার উদাহরণ পাবেন যারা হকার,মুচি বা চায়ের দোকানদার থেকে আমেরিকা,ভারতের মত দেশের প্রধান হয়েছেন বা আরো অনেক বড় কিছু।সাধারণ কোম্পানিতে চাকুরী না পেয়ে বেকারত্বের কষ্টে বিষের বোতল মুখে নিয়েও যে ছেলেটা ছিপি না খুলে ঘুরে দাড়িয়েছে সেই ছেলেটারই হয়তো সেই কোম্পানির থেকে বড় কোম্পানির মালিক হতে দশ বছরও সময় লাগেনি। ফেসবুক দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া নিউজে দেখলাম,জাপানের যে ছেলেটাকে একদিন সিনেমা দেখার সামর্থ না থাকার অভিযোগে বান্ধবী ছেড়ে গিয়েছিল,সেই ছেলেই একদিন পুরো সিনেমা হল বুক করেছিল তার বান্ধবীর জন্য।ধর্ষণ বা এসিডে মুখ ঝলসে যে নারী সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে নিজেকে শেষ করতে নদীতে ঝাপ না দিয়ে  বা গলার দড়ি খুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল খোজ নিয়ে দেখুন তার সেলাই মেশিনের আয়ে দিব্যি ছয় সদস্যের সংসার চলছে,ছেলে পরিত্যক্ত বৃদ্ধ মা-বাবার আহার জোগাচ্ছে।গড়ে তুলেছে শত সম্ভ্রমহীন নারীদের নিয়ে উদ্যোক্তা সমিতি। এ বছরেই সুমি নামের যে মেয়েটি ম্যাডিক্যাল ভর্তি  পরীক্ষায় তুমুল প্রতিযোগিতায় টিকে চান্স পেয়েছে সে স্বামী পরিত্যক্ত হয়েছিল বাবা রিক্সাচালক গরীব বলে অথচ সেই কিশোরী আজ ঘুরে দাড়িয়েছে, এখন হাজার মানুষের সেবাসহ সমাজের উচুতলায় অবস্থান সময়ের অপেক্ষা মাত্র,অস্তিত্ব টা ছিল বলেই এটা আজ উদাহরণ। অক্ষমের মত পালিয়ে আত্নহত্যা করলে হয়তো এ ঘটনা জানার সুযোগ পেতাম না আমরা।এমনই অনেক মেয়ের গল্প আমরা জানি যারা যৌতুকের টাকা দিতে না পেরে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আজ সরকারি আমলা হয়েছেন। যে ব্যক্তিকে ডিস্কভারি চ্যানেলে পৃথিবীর সব শাপ,ব্যাঙ খেয়ে পরিস্কার করতে দেখছেন,পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে দেখেন সেই বিয়ার গ্রিলও কিন্তু  চাকুরী জীবনের  প্রথম ধাপেই ট্রেনিং করতে গিয়ে পাজরের হাড় ভাঙার কারনে ডাক্তার তাকে আজীবন হাটতে পারবেন না বলে প্রতিবন্ধী হিসেবেই রায় দিয়ে ছিলেন অথচ সে ব্যক্তিই মনের জোরে ছয়মাস পর এভারেস্ট জয় করে প্রমাণ করেছেন খারাপ সময়টা দাত কামড়ে পাড় হতে দিতে হয়।পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে বা ভাল ভাল ভার্সিটিতে চান্স পাননি বলে ফ্যানের সাথে ঝুলতে চাচ্ছেন অথচ আপনার চেয়ে কম সিজিপিএ পাওয়া ছেলে বা মেয়েটা বিসিএস ক্যাডার হয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়ে বেড়াচ্ছে স্বপ্ন জয়ের।

যে ভালবাসার মানুষের জন্য মরতে যাচ্ছেন,আগামী দুই বছর পর হয়তো নিজেই তাকে ছেড়ে যাবেন।দশ বছর প্রেম করে দুই মাস সংসার করতে পারেনি এমন উদাহরণও আমাদের চোখের সামনে বহু দেখা যায়।প্রিয় ব্যক্তির পরকীয়ার কথা জানলে মান-সম্মান যাবে বলে সমাজকে ভয় পেয়ে মনের কষ্টে আত্নহত্যা করতে যাচ্ছেন, দুদিন টাকার অভাবে না খেয়ে থাকুন সমাজ তো দূরে থাক,আত্নীয় স্বজনও খুঁজে পাবেন না পাশে থেকে এক গ্লাস পানি উঠিয়ে হাতে দেবে ।পৃথিবীতে ব্যর্থদের ইতিহাস কেউ লিখে রাখেনা,আর এ জন্য যারা ঝরে গেল তাদের নাম তো দূরের কথা সংখ্যাও কেউ মনে রাখেনি। যোগ্যতা দিয়ে টিকে থাকুন,কঠিন সময় টা দাত কামড়ে পড়ে থাকুন,সময় পাড় হতে দিন, ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করুন সূর্য উঠবেই।কাউকে ভুল বুঝতে পাড়ার সময় দিন, ফিরে আসার সুযোগ দিন, না এলে বিকল্প খুজুন। আপনি ভাববেন না এই ঘরটায় আপনি না থাকলে ঘরটা সারাজীবন ফাকা পড়ে থাকবে বরং আপনার শূণ্যতা পূরনের জন্য আরো অনেকেই মুখিয়ে আছে।

এমন বহু গল্প আপনার চারিদিকে পাবেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্র‍থম সারির বিসিএস ক্যাডার বা সরকারী উচ্চ বেতন-ভাতার বড় কর্মকর্তা কিন্ত কেউ কারো জন্য সময় দেন না বা দিতে পারেন না অথবা প্রতিদিন দু:খের অনলে সংসার নামক কাঙ্ক্ষিত জীবনের স্রোত হারিয়ে মাদকাসক্ত অথবা সমাজের চোখে ভাল সেজে নিত্য নিজেকে পোড়াচ্ছেন।তাদের দিকে তাকান যারা নিজের ছোট বা আশানুরূপ চাকুরী না পেয়েও অথবা সামান্য দোকান ব্যবসা করেও যে সুখে আছেন তা উপলব্ধি করতে পারবেন।মাঝে মাঝে হাসপাতাল বা রেইল লাইনের পাশে বস্তি গুলো ঘুরে দেখে আসুন তাহলে বুঝবেন সৃষ্টিকর্তা আপনাকে বেকার বা কর্মহীন রাখলেও দুমুঠো খাবার নিজ হাতে তোলে খাবার সামর্থ্য দিয়েছেন এবং দিন শেষে মাথা গোজার ঠাই দিয়েছেন।

যে মেয়ের বা ছেলের বিয়ে হয়নি বলে অসস্তিতে ভুগছেন, আপনার কাছের বন্ধুকেই দেখুন না আপনার আগে আরও দুবার বিয়ে করে সংসার করতে গিয়েও হয়তো ডিভোর্স দিয়ে আপনার মত একাকী জীবন কাটিয়ে বিবাহিত জীবন বিরক্তিকর বলে আখ্যা দিয়ে আত্ন তৃপ্তিতে আছেন।

একটা কথা মনে রাখবেন,আপনার অনেক কিছুই দেখা হয়নি, শেখা হয়নি,জানা হয়নি।অন্তত নিজের জন্য না হলেও যে মা বাবা আপনাকে এতটুকু বুঝতে ভাবতে শিখিয়েছে,যার রক্ত চুষে আজ মানুষ নামের প্রাণী পরিচয় দিতে পারেন সেই গর্ভধারিনীর কথা ভাবুন,ভালবাসুন নিজেকে।

জীবন যুদ্ধে কাউকে সাথে না পেলে রবি ঠাকুরের গানটা মনে মনে গাইতে থাকুন "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...."। যারা সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছেন তারা এবার সিদ্ধান্ত নিন আপনি কী করবেন;যোগ্য প্রাণী হিসেবে টিকে থাকবেন নাকি অযোগ্য প্রাণীর মত বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকাভুক্ত হবেন সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।

লেখক: কলামিস্ট ও এন্টি-সুইসাইডাল স্কোয়াড(ASS) এর প্রতিষ্ঠাতা।
ই-মেইল:kabilsadi@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence