সাক্ষী নিরাপত্তা আইন: একটি অত্যাবশ্যক বিধান
- কামরুজ্জামান পলাশ
- প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ০২:৩৪ PM , আপডেট: ২৮ মে ২০২২, ০২:৩৪ PM
মহা পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআনের সূরা-২৩ ও আয়াত ১৪-তে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ইরশাদ করেছেন, “পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি আলাক-এ,অতঃপর আলাক্কে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থি-পঞ্জরে; অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢাকিয়া দেই গোস্ত দ্বারা; অবশেষে উহাকে গড়িয়া তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বত্তোম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!”। এই আয়াত দ্বারা মানব জাতির গুরুত্ব ও মহানুভবতা প্রকাশ পেয়েছে।
প্রাচীন গ্রীসের বিখ্যাত দার্শনীক এরিস্টটল বলেন,” মানুষ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে সকল প্রাণীকূল হতে উত্তম ; কিন্তু তখনই নগন্য হয়ে যায়, যখন সে আইন ও ন্যায় বিচার হতে আলাদা হয়ে যায়”।
আইন অঙ্গন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মানবজাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা একজন সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী ব্যক্তি ও একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান, কিংবা মামলা করা বা মামলার বিবাদী পক্ষ হতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রচুর মামলার জট হয়েছে। অধিকাংশ মামলার এখনও প্রক্রিয়াধীন বা পেন্ডিং রয়েছে শুধুমাত্র সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারনে। মানুষ সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে কেননা তাদের নিরাপত্তা প্রদানের আদৌ কোন প্রকার আইন নেই। যদি কোন সাক্ষী কোন প্রকার হুমকি বা প্রভাবিত বা প্রতিশোধমূলক আচরনের সম্মুখিন হয়, তাহলে তাদের নতুন করে একটি অভিযোগ দায়ের করতে হয়, যেহেতু এখনও অবধি চলমান বা এক্সিস্টিং বিচার প্রক্রিয়ায় (ট্রায়াল) অভিযুক্তের শাস্তির কোন প্রকার বিধান নেই। তাই নতুন করে অভিযোগ দায়ের অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ্য হয়ে উঠে। তাই অধিকাংশ সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে।
ভারতে প্রচুর পরিমান সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু কোন প্রকার সাক্ষী পাওয়া যায়না, কেননা কোন ব্যক্তিই তাদেরকে সমস্যায় জড়াতে চান না। তারা সাক্ষ্য প্রদান করার মাধ্যমে অনিরাপত্তায় ভুগেন। তাই অধিকাংশ মামলা অমিমাংশিত রয়ে যায়।
বাংলাদেশের চিত্রটা ও অভিন্ন বলা যায়। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ইং দৈনিক দেশ রূপান্তর সাক্ষী নিরাপত্তা আইনের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার মধ্যে কিছু ঘটনা হচ্ছে: লায়লা বেগম একটি হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন। পরবর্তীতে লায়লা বেগম অভিযুক্ত দ্বারা খারাপভাবে জখম হন এবং মারা যান। অভিযুক্ত উক্ত হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন।
পীর আলী একটি মামলার সাক্ষী ছিলেন। তিনি আদালতে সাক্ষ্য প্রদান না করতে হুমকির সম্মুখীন হন, যা পরিপ্রেক্ষিতে তিনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করেন। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার আত্মীয় স্বজনের অভিযোগ, তিনি আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের কারণেই তার (পীর আলী) এই পরিণতি।
আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাই যে, তারা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা প্রদান করে আসছে। যেহেতু মামলায় সাধারণত চার ব্যক্তিকে প্রধান অংশ হিসেবে ধরা হয়। তারা হচ্ছেন, বিচারক, অভিযোগকারী,অভিযুক্ত ও সাক্ষী। উপরিউক্ত বর্ণিত ব্যক্তিদের সাহায্য ছাড়া ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই উন্নত বিশ্ব তাদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে উল্ল্যেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে (ইউএসএ) সাক্ষী কিংবা ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করাকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। জাস্টিস ম্যানুয়েলের মতে, “সাক্ষীকে প্রভাবিত করা একটি অপরাধ যদিও এটি চলমান মামলা (পেন্ডিং) নয় এবং যদি সাক্ষী যদি প্রভাবিত ধরা হয়ে থাকে, তাহলে তার সাক্ষ্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহনযোগ্যতা (এডমিসিবিলিটি) পাবে না।“
যদিও প্রভাবিত করার পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়, সেটিকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হবে। কেননা এটি শুধুমাত্র সাক্ষীকে ভয় দেখানো নয়, বরং সাক্ষীর সাথে অন্য ব্যক্তি (আত্মীয়,স্বজন) কে ভয় দেখানোর অন্তর্ভূক্ত।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে (ইউএসএ) “ভিকটিম এবং উইটনেস্ প্রটেকশন এ্যক্ট ১৯৮২” ধারা-১৫১২ প্রণয়ন করা হয়। উক্ত ধারায় সাক্ষী সহ ভিকটিম ও অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করার কথা উঠে এসেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কেউ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি $২৫০০০০(দুই লক্ষ পঁঞাশ হাজার) ডলার অর্থে দন্ডে বা ১(এক) বছর কারাদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
“ভিকটিম এবং উইটনেস্ প্রটেকশন এ্যক্ট ১৯৮২” ধারা-১৫১৩ তে সাক্ষী সহ ভিকটিম ও অভিযোগকারীকে প্রতিশোধমুলক আচরন করার কথা উঠে এসেছে।এই ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কেউ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরন করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি $২৫০০০০(দুই লক্ষ পঁঞাশ হাজার) ডলার অর্থে দন্ডে বা ১০(দশ) বছর কারাদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
যুক্তরাজ্য ও ওয়েলস্ এ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরন করাকে আপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়। যাইহোক , সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরন “ক্রিমিনাল জাস্টিস এন্ড পাব্লিক অর্ডার এ্যক্ট ১৯৯৪” এর ধারা-৫১ অনুযাযী একটি দন্ডনীয় অপরাধ। সাক্ষীসহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ হতে রক্ষার্থে “ সিরিয়াস অর্গানাইজড্ ক্রাইম এন্ড পুলিশ এ্যক্ট -২০০৫” প্রণয়ন করা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) তে ২০০৬ সালে কঙোর ডেমক্রেটিক রিপাব্লিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদ জ্যান-পিয়্যারা ব্যাম্বা কে সাক্ষীকে প্রভাবিত করার দায়ে সাজা দেয়া হয়।
অন্যান্য দেশের ন্যায় আমরা এওধরনের আইন গ্রহণ করতে পারি। যেখানে সাক্ষী কিংবা ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে হুমকি প্রদান করলে তারা নতুন করে মামলা না করে চলমান বিচারিক মামলাতে (এক্সিস্টিং ট্রায়াল) একটি দরখাস্ত (পিটিশন) দিতে পারেন। দরখাস্তটি পাবার পর বিজ্ঞ বিচারিক আদালত উক্ত দরখাস্তের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন, এবং যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে চলমান বিচারিক মামলাতে (এক্সিস্টিং ট্রায়াল) অভিযুক্তকে সাজা প্রদান করতে পারেন।
এভাবেই চলমান বিচারিক আদালতে সাজা প্রদানের বিধানের মাধ্যমে মামলা সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বহু মামলা (মাল্টিপ্লিসিটি অব কেসেস ) কমানো সম্ভব হবে।
অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও বিচারিক কার্যক্রম মসৃন করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সাক্ষী সহ ভিকটিম অ অভিযোগকারীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন প্রণয়ন করা উচিত। কেননা নতুন করে মামলা করা খুবই কষ্টসাধ্য ও কিছু নিয়ম এবং প্রবিধান অনুসরণ করা সময় সাপেক্ষ্যও বটে। বিচারপ্রার্থীর দ্রুত সম্ভব ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কেননা উইলিয়াম গ্লাডস্টোন তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেন, “ Justice delayed is Justice denied."
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি