মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে
- ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
- প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২২, ১০:২৯ PM , আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২২, ১০:২৯ PM
সময় কত দ্রুত চলে যায়। দেখতে দেখতে এক বছর, ৩৬৫ দিন পেরিয়ে গেছে। আমাদের মা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে একেবারে না ফেরার দেশে। ১৮ মার্চ আমাদের মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে মায়ের বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে পারলৌকিক মহাজীবনে তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
‘মা’ একটি ছোট্ট শব্দ। এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, অকৃত্রিম স্নেহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সব সুখের কথা। কবি কাদের নেওয়াজ তাঁর ‘মা’ কবিতায় লিখেছেন- ‘মা’ কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।’ মা সম্পর্কে এ কথাটি চিরসত্য। মা কথাটিই কেবল মধুর নয়, মা সন্তানের জন্য পরম আপনজন। পৃথিবীতে সন্তানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হচ্ছে মা । মা করুণাময়ী ও স্নেহের খনি। মায়ের ভালোবাসা স্বর্গীয় ও স্বতঃস্ফূর্ত। স্নেহময়ী মায়ের হাসি, মন উজাড় করা ভালোবাসা, আদর-স্নেহে সন্তানের মনে বয়ে যায় অনাবিল আনন্দের ঝরনাধারা। সব দুঃখ-কষ্ট আর বেদনা ‘মা’ শব্দের মাঝে বিলীন হয়ে যায়।
বেগম হালিমা আজিজ আমাদের মা। প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়ার গণ্ডি বেশি দূর অতিক্রম করতে পারেননি। প্রাইমারি শেষ করে মাধ্যমিকে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন সবে। বয়স তখন ১৩’র কোটায়। এ সময়েই তাকে বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। এরপর প্রয় অর্ধ্ব শতকের যুগলবন্দী জীবনে ১০ সন্তানের জননী হন তিনি। মামাদের কাছে শুনেছি মা খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন। লেখা-পড়ার প্রতিও তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। কিন্তু অল্পবয়সে বিয়ে, তারপর সংসার-আর লেখাপড়া হয়নি তার। নিজে পড়া-লেখা করতে না পারার আক্ষেপটা মায়ের মাঝে ছিল সবসময়।
সম্ভবত নিজের এই স্বপ্নটা পূরণ করতে চেয়েছিলেন তার সন্তানদের মাধ্যমে। পরিবার ও সমাজের খুব গভীরে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন অপ্রাপ্তি ও অমর্যাদার দেয়াল ভেদ করে এদেশের মায়েরা সন্তানদের সফল এবং প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত নিয়ে আমরণ ত্যাগ স্বীকার করে যান। আমাদের মাও তাই করেছেন। নিজে না পারলেও সন্তানদের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে তার প্রচেষ্টা ও উদ্যোম ছিল- এক কথায় বলতে গেলে অনন্য অসাধারণ। মা’ই ছিলেন আমাদের প্রথম শিক্ষক। আমাদের গাইডও ছিলেন তিনি। অজপাড়া গাঁয়ে থেকেও আমাদের ১০ ভাই-বোনের উচ্চশিক্ষা লাভ বলতে গেলে আমাদের মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ত্যাগের ফল।
আরও পড়ুন: কেনেডি স্মৃতিবিজড়িত ঢাবির সেই বটগাছ পরিদর্শনে যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত
একজন বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন আমার মা। আর এ কারণেই মা শুধু আমোদের শিক্ষিত ও আলোকিত মানুষ করার চেষ্টা করেননি। তিনি তার সন্তানদের পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনটিও দৃঢ় করে রাখার চেষ্টা করেছেন আমৃত্যু। আমাদের পরম মমতায় তিনি যেমন আগলে রেখেছেন, আমরাও যেন পরস্পর পরস্পরকে এমনি করে আগলে রাখি এটা ছিল আমাদের কাছে মায়ের পরম চাওয়া। আমাদের সন্তনরাও যেনো এমনি করে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, পরস্পরের সুখে-দুঃখে মিলে-মিশে থাকে, তাদের প্রতিও এরকম উপদেশ ছিল আমাদের মায়ের।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের বাবা-মায়ের। অভাব না থাকলেও খুব বেশি সচ্ছলতা ছিল না। ১০ সন্তান নিয়ে বিশাল পরিবারটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক জাদুকরি ক্ষমতা ছিল আমার মায়ের। তিনি ছিলেন অল্পে তুষ্ট একজন মানুষ। তার সন্তানদেরও তিনি শিখিয়েছিলেন তা। কেবল নিজের জন্যই সকল প্রাপ্তি চিন্তা নয়, অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার শিক্ষাটাও আমাদের তার কাছ থেকেই পাওয়া। এমন আরো হাজারটা গুণের অধিকারী ছিলেন আমাদের মা।
সন্তানের জন্য সেরা উপহার হলো তার মা। পৃথিবীর সব ধর্মেই মা হচ্ছেন সন্তানের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। মায়ের কোল যে কত কত মূল্যবান তা একজন যোগ্য সন্তান ছাড়া আর কেউ জানে না। শত দুঃচিন্তা মাথায় নিয়ে একবার মায়ের কোলে মাথা রাখতে পারলে সব চিন্তা দূর হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো আরামপ্রদ জিনিসই মায়ের কোলে মাথা রাখার যে শান্তি, তার বিকল্প নয়।
আমাদের এই আশীর্বাদের আধার মা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে এক বছর হলো। বাবা গত হয়েছেন এক দশকেরও বেশি সময় আগে। পরম মমতা আর অফুরান ভালোবাসায় মা আগলে রেখেছিলেন আমাদের। সেই মাও চলে গেলেন। এটিই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। তবে মা বেঁচে থাকেন তার সন্তানদের মাঝে। আমাদের মাও বেঁচে আছেন আমদের অন্তরে, স্মৃতির মণিকোঠায় পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে। শেষ করছি প্রণব রায়ের বিখ্যাত গানের কয়েকটি চরণ দিয়ে-
মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে।
তার মায়ায় ভরা সজল দিঠি
সেকি কভু হারায়,
সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে
সন্ধ্যা রাতের তারায়,
সেই যে আমার মা
বিশ্বভূবন মাঝে তাহার নেইকো তুলনা।
মায়ের পরলৌকিক জীবন চির শান্তিময় হোক পরম করুণাময়ের কাছে এই বিনীত প্রার্থনা।
লেখক- অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়