দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, হালের জীবনব্যবস্থা ও প্রতিকার

রানা খায়রুল ইসলাম
রানা খায়রুল ইসলাম  © ফাইল ছবি

তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। অধিকাংশ জনসংখ্যা এখানে দারিদ্র্য সীমার মধ্যে বাস করে। বর্তমানে দেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। কালোবাজারী, মুনাফাখোর, মজুতদার প্রভৃতির কারণে খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জন্য।

জনজীবন আজ বিপর্যস্ত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে অশ্বের ন্যায় দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে প্রতিটি পণ্যের মূল্য।
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতিনিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরী, কালোবাজারীদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বর্তমান এই যুগে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেন অধিক মূল্যের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। অথচ এক বা দুই দশক আগেও এই অবস্থা ছিল না। মানুষ জীবন কাটাতো সাধ্যের মধ্যে ভালো থেকে। শায়েস্তা খাঁ’র আমলে টাকায় আট মণ চালের কথা যেন এখন রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামালও দেশের দ্রব্যমূল্য ছিল নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়।  দাঙ্গা আর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও দ্রবের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী আমাদের জীবনে অতর্কিতে হানা দেয়। ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যেতে থাকে। আর এরই ধারবাহিকতার চরম পর্যায় হলো বর্তমান অবস্থা। ভবিষ্যতে এই অবস্থা আরো নাজুক না হোক এটাই সবার চাওয়া।

বর্তমানে চাল, ডাল, তেল, মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মূল্যও বাড়ছে তরতর করে। নিচে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান চিত্র দেখানো হলো-

(ক) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যঃ ২০০২-এর জুলাইতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ছিল ৩৮-৪০ টাকা। ২০১৪ সালে এই মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। ২০০০ সালে প্রতি কেজি চাল পাওয়া যেত ১০-১২ টাকায়, বর্তমানে ৩০-৫০ টাকা। মাছ, মাংস, সবজি প্রভৃতির মূল্যও বেড়েছে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বেড়েছে অসহনীয় মাত্রায়।

(খ) পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলঃ পূর্বে ওয়াসা কর্তৃক সরবরাহকৃত প্রতি এক হাজার লিটার পানির মূল্য ছিল ৪টাকা ৩০ পয়সা। ২০০২ সালের আগস্ট মাসে ৪টাকা ৫০ পয়সা হয়, ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে করা হয়েছিল ৪টাকা ৭৫ পয়সা। আর বর্তমানে মূল্য আরো বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের বিল পূর্বে ছিল প্রতিমাসে সিঙ্গেল চুলা ২১০ টাকা এবং ডাবল চুলা ৩৩০ টাকা। জানুয়ারি ২০০২ থেকে করা হয়েছে সিঙ্গেল ২৭৫ এবং ডাবল ৩৫০ এবং মাত্র ৮ মাস চলার পরেই সেপ্টেম্বর ২০০২ থেকে মূল্য বাড়িয়ে আবার করা হয়েছে সিঙ্গেল ৩৫০ এবং ডাবল ৩৭৫ টাকা।

বর্তমানে সিঙ্গেল চুলা ৪০০ এবং ডাবল চুলা ৫০০ টাকা বা তার কিছু বেশি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিলও যেন প্রতিনিয়তই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। পূর্বে ১-১০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট মূল্য ছিল ২.২৬ টাকা। আর বর্তমানে ১-৭৫ ইউনিট ব্যবহার করলে, প্রতি ইউনিট ৩.৮৭ টাকা এবং ৭৬-২০০ ইউনিট ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট ৫.০১ টাকা করা হয়েছে (PDB নির্ধারিত)। এভাবে ক্রমাগত পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন বিলের অতিরিক্ত খরচ জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে করেছে দুর্বিষহ। কালোবাজারী, মুনাফালোভী, মজুতদারেরা এই সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলেছে। পণ্য ক্ষেত থেকে শহরের বাজার পর্যন্ত আসতে কৃষককে চাঁদা, দালালী, মধ্যস্বত্ত্বভোগী, পরিবহন খরচ প্রভৃতি বাবদ প্রচুর অর্থ গুনতে হয়। কৃষক তখন বাধ্য হয়ে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য মজুত রাখে আর শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। অনেক সময় আমদানী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে বিক্রয় করে ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাথাপিছু ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, জমির অনুর্বরতার দরুন উৎপাদন কম হওয়া, অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে পর্যাপ্ত পণ্য বাজারজাত না হওয়া, চোরাচালান ইত্যাদি কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হচ্ছে আকাশচুম্বী।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যদিও সারা বছরের ঘটনা তবুও রমজান মাসে প্রত্যেক পণ্যের মূল্য হয়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। আবার রাজনৈতিক কারণে যেমন- হরতাল, অবরোধে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মূল্যও বেড়ে যায় বহুগুণ। এছাড়াও ঈদ, পূজাসহ পহেলা বৈশাখে এবং বিভিন্ন উৎসবের সময় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভবিক বেড়ে যায়।

দ্রব্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সাথে খাপ খায় না তখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চরম কষ্টে পড়ে যায়। আর নিম্ন আয়ের বা বেকার মানুষগুলোর অবস্থা হয়ে যায় অবর্ণনীয়। অর্ধাহারে, অনাহারে কাটাতে হয় হত দরিদ্র মানুষদেরকে। অনেক সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যায়, ফলে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি দুর্যোগ। এছাড়া জনমনে ক্ষোভ, হতাশা জমে তার রূপ নেয় বিক্ষোভে ও আন্দোলনে। দেশে বিরাজ করে অস্থিরতা।

দেশে বিরাজ করে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা, ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে। সীমাবদ্ধ ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে পণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে কোণঠাসা, দিশেহারা, উদভ্রান্ত।

সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এ জন্য দেশের কালোবাজারী, চোরাচালানী রোধ করতে হবে সবার আগে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্য মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আয়ত্বে থাকবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই দুঃখের দিনেও আশার কথা হচ্ছে দ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রব্যমূল্য যাতে বিক্রেতারা ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে তার জন্য দোকানে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য তালিকা টানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এ বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য ‘টিসিবি'কে (Trading Corporation of Bangladesh) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে থাকে। এছাড়া দেশের ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে সরকার।
শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষকেও দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও হরতাল, অবরোধের মতো কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।

লেখক
রানা খায়রুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ