শতবর্ষে ঢাবি: ‘তিন ইহুদির কারসাজি’, নবাবদের জায়গাজমি ও বাস্তবতা
- আলমগীর শাহরিয়ার
- প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৭:৩৪ PM , আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:২৯ PM
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নবাব পরিবারের দান করা জায়গা জমি নিয়ে নানাজনকে বিতর্ক করতে দেখলাম। শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এমন বহুমাত্রিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব পরিবারের অবদান আছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০০ একর ভূমি নবাব পরিবার দিয়েছিল এটা যতোটা না সত্য তারচেয়ে বেশি একটা মিথ হিসেবে চালু আছে। কেননা ইতিহাস পাঠে ও সত্য অনুসন্ধানে আমরা বরাবরই বিমুখ।
ঢাকাকে নগরীর মর্যাদা দেয় প্রথমত মুঘলরা। ১৬০৮ সালে ঢাকায় প্রথম মুঘলদের পা পড়ে। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। তার আগে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় বাংলার রাজধানী ছিল বিহারের রাজমহলে। সেই প্রথম ঢাকা রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। ১৬১০ সালে ইসলাম খান চিশতি মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। রমনা এলাকা ওই সময়েই গড়ে ওঠে। বাংলা তাদের কাছে ছিল একটি সুবা। সুবা মানে প্রদেশ। ডাকা হতো সুবা বাংলাহ বলে। এর প্রধানকে বলা হতো সুবাদার। ব্রিটিশ আমলে গভর্নর যেমন। আঠারো শতকের শুরুতে অর্থাৎ ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁন ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন মুর্শিদাবাদে।
ইংরেজরা শাসন ক্ষমতায় আসার পর কলকাতা রাজধানী হলে ঢাকা গুরুত্ব হারায়। যদিও কলকাতার চেয়ে অনেক পুরনো শহর ছিল ঢাকা। কিন্তু বন্দর কেন্দ্রিক বাণিজ্যের জন্য কলকাতা প্রাধান্য পায়। ব্রিটিশ শাসনামলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকা কিছুটা সরব হয়। অনেক বছর পর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নিলে ঢাকার আবার গুরুত্ব বাড়ে। এসময় বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ তখনকার সেক্রেটারিয়েট ভবন নির্মাণ হয়, কার্জন হল, পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারের বাসভবন হিসেবে বর্তমান হাইকোর্টের পুরনো ভবনটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় (ঢাবির ভিসি চত্বর থেকে পলাশী যেতে যে 'ফুলার রোড' সেটি গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারের নামেই নামকরণ হয়)। যদিও তিনি এখানে বাস করেননি। পরে প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের কোনো অধিবেশনও এখানে বসেনি।
মূল ঢাকার উত্তরে বিস্তীর্ণ এ অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। ঢাকার নবাব পরিবার এখানে একটি রাজকীয় বাগান তৈরি করেন যার নাম দেওয়া হয়—শাহবাগ। জানা যায়, নবাব আহসানউল্লাহর তিনটি বাগান বাড়ির একটি ছিল এই শাহবাগে। বর্তমান মধুর ক্যান্টিন ছিল একসময় বাঈজিদের নাচ ঘর। 'আসদুগানে ঢাকা'র লেখক হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, এটি ছিল বাগানবাড়ির দরবার কক্ষ। পরবর্তী কালে এখানেই ১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ গঠিত হয়। মুঘলদের পর ব্রিটিশরা এসে এ এলাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলে। রেসকোর্স ময়দান, রমনা পার্ক প্রভৃতি। রমনা এলাকার গোড়াপত্তন হয় অবশ্য মুঘল আমলেই। ঢাকা আবারও প্রাণ ফিরে পায় ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ার পর। রমনা, নীলক্ষেত, মিন্টু রোড, হেয়ার রোড এলাকাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় নতুন শহর। বঙ্গভঙ্গ রদের পরে আবার সবকিছু থমকে যায়।
আরও পরে বুদ্ধদেব বসুর ত্রিশের ঢাকায় বসবাসের বর্ণনা যদি দেখি তিনি লিখছেন, "আমরা প্রথম যখন পুরানা পল্টনে এলাম তখন এবড়ো-খেবড়ো মাঠের মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো তিনটি মাত্র বাড়ি উঠেছে, আরো দু-একটা নির্মীয়মাণ। সবগুলোই পশ্চিম বাংলার ভাষায় কোঠাবাড়ি-পূর্ববাংলায় বলে দালান-শুধু আমাদেরটাই নয়।... আমাদের পুবে-উত্তরে বনজঙ্গল-অনির্ণেয় গ্রাম-আর দক্ষিণে তাকালে চোখ চলে যায় রেল-লাইন পেরিয়ে নবাবপুরের প্রথম কয়েকটা বাড়ি পর্যন্ত ঝাপসা-দুপুরবেলার রোদ্দুরে যেন কাঁপছে। আমার ঘরের বাইরে তুলসীমঞ্চ, পাতার ফাকে নীল চোখ মেলে বর্ষায় অপরাজিতা তাকিয়ে থাকে।" সেই পল্টন আর রমণীয় রমনা আজ কেবল ইতিহাসের পাতায়।
বঙ্গভঙ্গ রদের একটি রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন প্রদেশের সরকারের জন্য নির্মিত ভবনসমূহ আর রমনার সবুজ পরিবেশে ১৯২১ সালে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞানার্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের চিত্ত বিকাশের কথা চিন্তা করে মনোরম একটি পরিবেশও পরিকল্পনাকারীদের ছকে ছিল। নবাবদেরও এখানে কিছু জায়গা ছিল। কিন্তু তারা এ জায়গা পেয়েছিলেন কোথায়? পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নবাবদের সম্পত্তি ছিল, তাদের দান ছিল — এ দাবি সর্বাংশে সত্য নয়। অধিংকাংশ জায়গা ছিল খাসমহল। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ: অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা' গ্রন্থে সরদার ফজলুল করিম অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সলিমুল্লাহ হল নিয়ে জানতে চান।
হলের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নিয়েও তিনি তাঁর মত দেন। 'স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্রদের যে প্রথম ছাত্রাবাসের নাম যে সলিমুল্লাহ হল রাখা হল এর কারণ কি? এতে নওয়াব পরিবারের কি কোন আর্থিক কনট্রিবিউশন ছিল?' কৌতূহলী এ প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেন, "আদৌ কোন কন্ট্রিবিউশন ছিল না। আবদুল্লাহ 'সোহরাওয়ার্দী' লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছিল। এরা আহসান মঞ্জিলের টাকায় লেখাপড়া করেছে। এরা সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত। ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রায় দশ বছর পরে তাঁর একটা মৃত্যবার্ষিকীতে তাঁর নামে একটা ছাত্রাবাসা করার প্রস্তাব এঁরা করেন। মুসলিম ছেলেদের জন্য হল তখন হয়ে গেছে। প্রথমে এ হল ছিল এখনকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিল্ডিয়িংয়ে। আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী বললেন : এ হলকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল করা হোক।"
এখানে অধ্যাপক রাজ্জাক একটি তথ্য যোগ করেন। তিনি বলেন, "কোন মুসলমান ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাইরেক্টলি কোন ফাইনেন্সিয়াল কন্ট্রিবিউশন পায় নাই।।" অথচ অন্য সূত্রে জানা যাচ্ছে, মুসলমানদের কংগ্রেসী নেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল তখন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীকে এক হাজার এবং তাঁর সঙ্গে সৈয়দ হাসান ইমাম পাঁচ শত টাকা দান করেন। যতই অল্প হোক সে দান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরকম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কানাকড়িও দান পায় নি। বরং বিরোধিতার অভিযোগ আছে। এই বিরোধিতাকারীদের মধ্যে আছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রসুল, মাওলানা আকরম খাঁ, মৌলবি আবুল কাসেম, বিহারের মৌলবি লিয়াকত হোসেন প্রমুখ। অন্যদিকে, হিন্দু বিরোধিতাকারী জাতীয় নেতাদের মধ্যে স্যার আশুতোষ ছাড়াও ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদার প্রমুখ । ঢাকার হিন্দু নেতাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার প্রভাবশালী আইনজীবী ও সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান আনন্দচন্দ্র রায়, বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে হিন্দু এলিট শ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, কলকাতাকেন্দ্রিক আইন ব্যবসার প্রসার কমবে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তৎকালীন শিক্ষাবিদদের একাংশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা' গ্রন্থসূত্রে জানা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তখন হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতারা তিন ইহুদীর কারসাজি বলেও চিহ্নিত করেছিলেন। এই তিন ইহুদী ছিলেন ১. উপাচার্য পি জে হার্টগ, ২. গভর্নর জেনারেল লর্ড রিডিং ও ৩. ভারত সচিব মন্টেগু। শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা নয়, বিরোধিতায় মাঠে সক্রিয় ছিলেন মুসলমানদের একাংশও। তাদের অনাগ্রহ বা উদ্বেগের কারণ ছিল—মুসলমান এলিটদের নেতা স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে সদ্য প্রতিষ্ঠিতআলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও গুরুত্ব কমে যাবে বলে।
ফিরে যাই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কথায়। তিনি বলছেন, "সলিমুল্লাহ হল যে তৈরী হলো তা পুরোই সরকারের টাকায়। নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; জায়গাতেও নয়। রমনায় যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি। তা পুরাই খাসমহল এবং সরকারের জমি। সেটেলমেন্ট রিপোর্টে-এ তাই আছে। বরঞ্চ লাখেরাজ সম্পত্তি বললে রমনা কালিবাড়িকে বলা যায়। ঢাকা শহরে লাখেরাজ সম্পত্তি কি এ নিয়ে আলোচনা চলছে ১৮১৫ কি ১৮২০ থেকে।" ঢাকার নওয়াবদের ভূসম্পত্তির উৎস কি? একই আলোচনায় রাজ্জাক স্যার বলছেন, "ঢাকার নওয়াবদের জমিজামা এসেছে প্রধানত একটি সূত্রে থেকে। ঢাকার স্থানীয় মুসলমানরা কোন কোন সম্পত্তি নওয়াব আবদুল গণি ও আহসানউল্লাহকে ওয়াকফ করে দিয়ে যেত। ঢাকার নবাদের জমির উৎস এই। তাও বেশিকিছু জায়গা জমি নয়। এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পারেন। কাজেই নবাব পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি দিবে, এমন জমি কোথায় ছিল? আহসান মঞ্জিলের কোন জমি ছিল না।"
সৈয়দ আবুল মকসুদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কাজে এ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠালগ্নে সলিমুল্লাহর নবাব এস্টেট থেকে ৬০০ একর জমি দান করার অঙ্গীকারের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দিয়েছিলেন বলে তাঁর কোনো প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। লেখক অন্যত্র ৩০০ একরের কথা উল্লেখ করেছেন সেটা ধীরে ধীরে বেদখল হয়ে যায় বলে জানান। ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এফ রহমানের সঙ্গে তৎকালীন বৃটিশ-ভারত সরকারের ২৫৭. ৭০ একর জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার দলিল আছে। এর বাইরে আর কোন দলিলের হদিস নেই।
লেখক: কবি ও গবেষক
alo.du1971@gmail.com