এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
- আশরাফ রাব্বী
- প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:০৫ PM , আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:০৫ PM
করোনা সংক্রমণের খড়গ নিয়েই ভারতের বিহার রাজ্য নির্বাচনে তিন দফা ভোট গ্রহণ শেষে ১০ নভেম্বর ফল উন্মুক্ত হলো। ভোটের রাজনীতিতে জ্যোতিপূর্ণ নজির হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে নির্বাচনটি। তুলনামূলক ফলাফল বিশ্লেষণের পূর্বে হিন্দি বলয়ে থাকা রাজ্যটির জাতিভিত্তিক নির্বাচনী সমীকরণে আলোকপাত করা যাক।
৪১৩ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত শাসনামলে মগধে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ মহাবিহার পাল আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় পূর্বগামিতা অর্জন করে বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় রূপে নালন্দা নামে সদম্ভ আত্মঘোষণা করে। হাল আমলে রাজ্যে ৫ বছরের নিচে স্নাতক সম্পন্ন হচ্ছে না, স্কুল-কলেজে শিক্ষক সংকট, বাইরের রাজ্যে পড়তে যেতে হচ্ছে, শিক্ষকদের চাকুরির স্থায়ীত্ব ও পারিশ্রমিক বিব্রতকরভাবে অত্যধিক কম। হাসপাতালে সুচিকিৎসার বড্ড অভাব; এইমস আজও প্রতিষ্ঠিত না হওয়া। ৬০ লক্ষাধিক শ্রমিকের বাইরে কাজ করা, করোনাকালে সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যর্থতা উলঙ্গভাবে বেড়িয়ে আসা। ৪৫ শতাংশ কৃষি নির্ভরতা ২৩ শতাংশে অবনমতি হলেও কৃষকের স্বচ্ছলতা আনয়ন না হওয়া। বেকারত্ব, মাথাপিছু আয়, সাক্ষরতার হার, গড় আয়ু- প্রায় সকল সূচকেই ভারতের জাতীয় গড় থেকেও নিচে বিহারের অবস্থান। সরকারি চাকুরি তো দূরস্থান ন্যূনতম আয়ের হাতেগোণা উপায়। দৈনিক ১০০ রুপির নিচে বিস্তৃত অংশের পরিবাররিক আয়।সর্বোপরি, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় কেন্দ্রিয় সরকারের বিশেষ অনুকম্পা – নির্বাচনের চর্চিত বিষয়বস্তু।
“বিশালায়তন নগরীং রম্যাং দিব্যাংশু স্বর্গোপমাং তদা” আপ্তবাক্যে গৌতম বুদ্ধ প্রভাবিত বিশ্বের প্রাচীনতম গণগন্ত্র লিচ্ছবি গণরাজ্যের রাজধানী বৈশালীকে আধিদৈবিক রামায়নে শংসা করা হয়েছে। সেই বিহার আজ জাতপাতে জর্জরিত। আপাতবিরোধী তর্ক সাপেক্ষে কোন আসনে ১০ শতাংশের বেশি একক জনগোষ্ঠীকে প্রভাবশালী গণনা করে ছক কষলে বিভিন্ন জাতের একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ১৪৩ আসনে যাদব ভোট বেশি; ১১৩ আসনে মুসলমানদের ভোট। এই দুইটি জাতিকে একত্র করলে ৮৩ আসনে এগিয়ে থাকা যায় যা লালু প্রসাদ যাদবের নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক। ২০১৫ সালে ৮০টি আসন প্রাপ্তি সমীকরণের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। তেজস্বী এ সমীকরণ অটুট রেখে বাম, কংগ্রেস এবং যুবকদের টেনে ১৪০ আসনে মহাগঠবন্ধনকে বিজয়ী করতে চেয়েছিলেন, ব্যর্থ হয়েছেন। জেডিইউহীন লড়াই কিছুটা ভুগিয়েছে এবং ৭৫ আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এতে আসাদুদ্দিনের বৃহৎ ঋণাত্মক অবদান আছে যা নেহায়েত ২০ আসনের কম নয়।
এবার আসা যাক উত্তরের উচ্চবংশীয় হিন্দুদের নিয়ে। সেখানে ৫৩ আসন ব্রাহ্মণ প্রভাবিত, রাজপুত ৫৭ আসন এবং ভূমিয়ার ৪৪ আসনে প্রভাবশালী। এদের একত্র করলে ৬০ টি আসনে উচ্চবংশীয় ভোটের রাজনীতি হয় যা সরাসরি হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ভোট ব্যাংক। ২০১৫ সালে বিজেপি এভাবেই ৫৪ আসন নিয়েছিলো, এবার বিভিন্ন ভোট কাটুয়া গোষ্ঠী ও জেডিইউর সাহায্যে কুঁড়িটি আসন বৃদ্ধি করেছে চাতুর্যের সাথে। নীতিশ কুমারের ভোট ব্যাংক কুর্মি( ৩১ আসন) ও মহাদলিত(২৬ আসন)। এছাড়া কুসবহা ৪০ আসন এবং চিরাগ পাসোয়ান ১৮ আসনে ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব বহন করে।
মাসখানেক পূর্বেও বিহারে তেজস্বী উদ্ভিন্ন লড়াই করবে ছিলো ভাবনাতীত। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী বছরেই বিজেপির ভোটে ১৩-১৪ শতাংশ অবনমন ঘটেছে। আসনের হিসেবে ২৪৩ বিধানসভা আসনের মধ্যে ২২৩ টি আসনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জয়যুক্ত হয়েছিলো। এবার এক ধাক্কায় কমে ৭৪; নীতিশের জেডিইউ ৪৩। জিতেনরাম মাঝি এবং মুকেশ সাইনির দল ৪ টি করে আসন পেয়েছে। মুকেশ সাইনি প্রথমে মহাগঠবন্ধনের সাথে থাকলেও অপচিকীর্ষায় জোট ত্যাগ করে এনডিএ তে স্থলিত হয় অন্তিমক্ষণে।
অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন এ নির্বাচনে চমকপ্রদ গোলটি দিয়েছে বিজেপি। তাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন, পুরো হিন্দিল্যান্ড তাদের করায়াত্ত্বে থাকবে। ম্যারাথনের টর্সোটিতে বুক ছোঁয়াতে আর দীর্ঘ অপেক্ষা নেই। উন্নাসিক নীতিশ এতদিন বিজেপিকে ছোট ভাই জ্ঞান করে আসলেও সে সুযোগ থাকছে না। ২০০৫ এ রাবড়ি দেবীকে সরিয়ে গদিতে বসতে অটল বিহারী বাজপেয়ীর অবদান কম নয়। অকৃতঘ্ন নীতিশ আজীবনেই সঙ্গীকে ধোঁকা দিয়েছেন হোক ফার্নান্দেজ, লালু প্রসাদ কিংবা বিজেপিকে। ২০১৩ সালে এনডিএ ত্যাগ মোদী-শাহ জুটি ক্ষমার্হ, তিতিক্ষা বা নির্লিপ্ততায় নয় বরং প্রতিহিংসায় গ্রহণ করেছে। তাই রাজ্য দখলের প্রশ্নে ২০১৭ সালে তাকে গ্রহণ করলেও ২০২০ সালে চূড়ান্ত প্রতিশোধটি নিলো এলজেপিকে দিয়ে খেলিয়ে। চিরাগ পাসোয়ানকে দিয়ে জেডিইউর ভোট কর্তনের পরিকল্পনা কোন জুগুপ্সা ছিলো না। বিজেপি সাক্ষী গোপাল হয়ে পুরো বিষয়টা দেখেছে। খালি চোখে এলজেপির পরিকল্পনা পর্বতে মুষিক প্রসব জ্ঞান করলেও আদতে বিজেপির সবচেয়ে বড় উপকারটি করেছে এলজেপি ই ; সম্ভবত কেন্দ্রে মন্ত্রিত্বও পেতে চলেছে পুরস্কার স্বরূপ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্যে বিজেপি নীতিশকে খুব একটা ঘাঁটাবে না। তাছাড়া মহারাষ্ট্রে শিবসেনা এনসিপির কাছে হারের ক্ষতটা দগদগে। নীতিশ এখনো ঢাকের বাঁয়া না হলেও ভবিষ্যৎ দুরতিক্রম্য করে ফেলেছেন।
এই অসেচনক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তেজস্বী প্রসাদ যাদব রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে দুর্জয়-তীরন্দাজ হিসেবে নিজেকে স্থাপিত করেছেন পিতামাতার ছায়া সরিয়ে। ভূয়োদর্শী মনোজ ঝা'র প্রভাবে আরজেডি-বামপন্থী দলগুলি রাজঘোটক হয়ে ধরা দিয়েছে। দেশব্যাপী অপসৃয়মান বামেরা এই নির্বাচনের সবচে বড় তুবড়ি। মাঠের রাজনীতির সম্পৃক্ততায় মৃন্ময় দ্যুতি ছড়ালো সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই(এমএল)। প্রথমোক্ত দলদ্বয় নব্বই দশক থেকেই লালু প্রসাদ যাদবের সঙ্গ দিলেও সিপিআই(এমএল)'র সাথে আরজেডির আদায় কাঁচকালায় সম্পর্ক ছিলো। উভয়দল বীতরাগ হয়ে পরস্পরের দিকে প্রত্যুদগমন করেছে দল-জাতি-মতের ঊর্ধ্বে উঠে। আগামী কয়েকদশক যেমন ৩১ বছর বয়সী তেজস্বীর হতে চলেছে তেমনি নকশাল ভাবধারার মেহনতী মানুষের সিপিআই(এমএল)এর ও। ২৯ আসলে লড়ে ১৬ আসন দখল বামেদের জন্যে দুর্দৈব বটে। আরও বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের প্রাপ্য ছিলো। নব্বই এর দৌঁড়ে লালু প্রসাদ যাদব নিম্নবর্গের হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের সামাজিক সাম্য- ন্যায়ের আন্দোলন করেছেন; এবার তার পুত্র অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিরোধিগণের দুর্বিষহ তামসিক “জঙ্গলরাজের” তকমা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রপাগন্ডা যা মূলত উচ্চবর্গের হিন্দুদের ক্ষোভের ফসল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন রচিত সিংহ সেনাপতি উপন্যাসে নায়ক সিংহকে আচার্য বলেন,”আর্যরা ভাই-ভাই হতে পারে, কিন্তু তাদের কেউ দেবতা বা রাজা হতে পারে না।“ কিন্তু ধর্মের ষাঁড়েরা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সেজে রাজ্যে জাত-বর্ণের ভিড়ে ধর্মকেই তিরোধানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
কংগ্রেসের জন্যেই মহাগঠবন্ধন জয়মাল্য বঞ্চিত- শক্ত করেই বলা যায়। কী বিভৎস! ৭০ আসনে লড়ে ১৮ জয়। নীরস-কঠিন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মনোনয়ন বানিজ্য, স্বজনপ্রীতি, গান্ধী পরিবারের নিষ্ক্রিয়তা, রাহুল গান্ধীর মাত্র ছয়টি দায়সারা সমাবেশ, রাজপুত প্রভাবিত আসনে যাদব প্রার্থী কিংবা নিম্নবর্গের আধিক্যবহুল আসনে ব্রাহ্মণ প্রার্থী দেয়ার ফল ২৭ থেকে ১৮ আসনে অধোগতি।
পশ্চিমবঙ্গ–বিহার সীমান্তে শেষদফায় হওয়া ভোটের আশি শতাংশ মহাগঠবন্ধন পাওয়ার কথা থাকলেও বিরোধিদের ভাষ্যে শকুনি মামা খ্যাত আসাদুদ্দিন ওয়াইসি শিরে সংক্রান্তি করে দিয়েছেন। কিষাণগঞ্জে ৭০ শতাংশ, আরারিয়ায় ৪২ শতাংশ, কাটিহারে ৪৩ শতাংশ এবং পূর্ণিয়ায় ৩৮ শতাংশ মুসলিম আবাদি। গাছ পাথর করে এসব অঞ্চলে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি মাটি আঁকড়ে পরেছিলেন, ঈদও করেছেন বিহারে। নির্বাচনে করেছেন পয়ষট্টির অধিক সমাবেশ। ফলশ্রুতিতে ৫ টি আসনে তাঁর দল এবং ১ টি আসনে মায়াবতীর দল জয়লাভ করেছেন। চিন্ময় অমিত শাহ ঠিক ওই সময়েই সীমান্তের এপারে পশ্চিমবাংলায় এনআরসি, অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে মুসলিম ধ্রুবিকরণে লিপ্ত একইসাথে যোগী আদিত্যনাথের উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতিবাদ তরুণ মুসলিমসমাজ আসাদুদ্দিনেই খুঁজে পেয়েছেন। কুসবহা, মায়াবতী ও আসাদুদ্দিনের দল আরজেডিকে অনধিক ২০ টি আসনে হারিয়েছে। কিছুপূর্বে কিশাণগঞ্জ উপ-নির্বাচনে আসাদুদ্দিনের প্রার্থী কংগ্রেসকে পরাস্ত করে নিজেদের রণভেরী বাজিয়েছিল যা কথিত বড় দলগুলো নথ নেড়ে ধর্তব্যে নেয়নি।
মাধুকরী কংগ্রেস খারাপ ফল করার জন্যে, দুর্নিবার তেজস্বী সীমিত ব্যবধানে মুখ্যমন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বেদনায়, রোরুদ্যমান নীতিশ কুমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুলভ অভিভাবকত্ব হারানোয় মুর্ছা যাচ্ছেন। সকলের মনোবীণায় অনুক্ষণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরে, মিথিলার কবি বিদ্যাপতির ব্রজবুলি ভাষায় রচিত অমর গীত ঝংকৃত হচ্ছে-
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়