আত্মহত্যা: নেপথ্যে হতাশা, মানসিক চাপ এবং সামাজিক দায়

  © সংগৃহীত

‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়? দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়’। জয়-পরাজয় আছে বলেই হয়তো জীবনের উত্থান-পতন আছে। কয়জনই বা পারে সেসব উত্থান-পতন মেনে নিয়ে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে? টিকে থাকতে না পেরে ঝরে যাচ্ছে অনেক সত্তা, বাড়ছে মৃত্যু। এটার নাম নাকি আত্মহত্যা যেটি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটি শব্দ ও কাজ।

ঘটনাগুলো ঘটে চলে হরহামেশাই। আর আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাদের সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে যন্ত্রণাদায়ক এই অপমৃত্যুকে। আর এখানেই উদ্বিগ্নতার শুরু-আত্মহত্যাকারীর হতাশার শেষ ধাপ- আত্মহত্যায় গমনের কারণ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আত্মহত্যাকারী কি স্বার্থপরের মতো পৃথিবীকে বিদায় জানান? এ বিষয়গুলো জানার জন্য যেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, ঠিক সেখান থেকেই আমরা এর কারণ এবং এটা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় খুঁজতে থাকি।

এক্ষেত্রে আত্মহত্যাকারীর কাছের লোকজন বা যারা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, তারা বিভিন্ন ধরনের নির্ধারক দাঁড় করান। বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে বলা যায়, ‘self- injurious’ আচরণ যে তরুণদের ভেতর বেশি, তাদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি কাজ করে বা যারা মাদকাসক্ত, পরিসংখ্যান বলছে- তাদের প্রতি ২০০ থেকে ৪০ জনের মধ্যে একজন এক বছরের মধ্যে এবং প্রতি ১৫ জনে একজন ৯ বছরের মধ্যে আত্মহত্যা করেন।

যখন হতাশা দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে, মস্তিষ্কের কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের সমন্বিত কার্যক্রমে আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে। এদের অনেকেরই শৈশবকালীন বা জীবনের শুরুতেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের ইতিহাস থাকে।

আত্মহত্যার বিষয়টা যতটা ব্যক্তিগত বা মানসিক, ঠিক ততটাই পারিবারিক এবং সামাজিক। পরিবারের সদস্যদের অত্যধিক প্রত্যাশা মেটানোর উচ্চাকাঙক্ষা, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে জেনারেশন এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং লেভেলের গ্যাপ, ব্যাক্তির হীনমন্যতা আর হতাশা অপমৃত্যু নামক আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয় যেমন- অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য, পোশাক, কসমেটিক্স, সিজিপিএ, সহশিক্ষা কার্যক্রমে একেকজনের ভিতর সুস্পষ্ট পার্থক্য দীর্ঘমেয়াদী হতাশায় পরিণত হলে তা আত্মহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিবাহ বহির্ভূত প্রেম- ভালোবাসার সম্পর্ক পরণতি পাওয়ার উচ্চ প্রত্যাশা , বৈবাহিক জীবনে অশান্তি, পরকীয়া, অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণতা, প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়া, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষার পরে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিকেন্দ্রিক হতাশা, দরিদ্রতা এবং পারিবারিক অসচ্ছলতা যুবসমাজকে বহুলাংশে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।

সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদগণ সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মনে করে, ‘প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সমাজ, সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি।’ ঠিক এই জায়গাটি থেকে আমরা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি না। প্রতিটা আত্মহত্যার নিজস্ব কারণ থাকে। কাকতালীয়ভাবে একটি আরেকটির সাথে মিলে যেতে পারে। কারণ পারিপার্শ্বিকতাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা এক নয়।

প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাদের আবেগ-অনুভূতিও আলাদা। আশেপাশের বা পরিচিত মানুষগুলোর সাথে আন্তরিক হয়ে তাদের সাথে সময় দিলে, সমস্যা-সমাধান শেয়ার করলে সমস্যার শিকার যে ব্যক্তি তার অনেকটা ভারমুক্ত লাগে। নিজেদের ভেতর সহিষ্ণুতার চর্চা করে অন্যের দুর্বল দিকগুলোকে (গায়ের রং, উচ্চতা) আঘাত না করা, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কারো সম্পর্কে বিকৃত বা কুরুচিপূর্ণ তথ্যের মাধ্যমে ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে নিপীড়ন না করা।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ট্রেইনার বা স্যাইক্রিয়াটিস্ট দ্বারা কাউন্সিলিং, বিভিন্ন ইনফোগ্রাফিক্স, সেমিনার বা ওয়েবিনারের আয়োজন করে কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়। এছাড়া নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, সরকারি খাতগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও সুযোগ সৃষ্টি, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কিছু অনুদান বা প্রণোদনা একঘেয়েমি জীবনে নতুন মাত্রা দিতে পারে, যা হয়তো হতাশা মুক্তির একটি উপায় হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি সমাজভেদে নৈতিকতা এবং ধর্ম চর্চাও মানবজীবনে প্রশান্তির বার্তা বয়ে আনে।

সব থেকে বড় কথা হচ্ছে নিজেকে সময় দিয়ে নিজের ইচ্ছা, আগ্রহ, পারা না পারার ক্ষেত্রগুলো আবিষ্কার করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা উচিৎ। সম্পর্কগুলোকে সামাজিক পুঁজি হিসেবে বিবেচনা করে গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ জীবনে অনেকটা স্বস্তি এনে দেয়। ‘কতটুকু নিয়ে বাঁচতে পারছি?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার থেকে ‘কতটুকু ছাড়া বাঁচতে পারছি?’ এই প্রশ্নের উত্তর বেঁচে থাকার জন্য অনেক খানি অনুপ্রেরণা যোগায়।

আমাদের সামাজিকতা, সংস্কৃতি, সর্বোপরি জীবনধারণে ইতবাচক পরিবর্তনই পারে অনেকগুলো সত্তার অকালে ঝরে যাওয়া অনেকাংশে কমিয়ে আনতে। আর সুস্থ সমাজের জন্য এই বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজ এবং রাষ্ট্র উভয়ের ভূমিকা অতীব জরুরি। সবশেষে বলব ‘জীবন জয়ী হোক’।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence