শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও শহীদ হাদি: ইতিহাসের ২ জানাজা নামাজ, একই জনস্রোত
- অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন
- প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৬ PM
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও শহীদ শরীফ ওসমান হাদী: ইতিহাসের দুই জানাজা নামাজ, একই জনস্রোত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও শহীদ শরীফ ওসমান হাদী- দুই ভিন্ন সময়, দুই ভিন্ন স্টাটাসের মানুষ; কিন্তু জানাজার জনসমুদ্রে ইতিহাসের এক আশ্চর্য মিল আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।
১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজা নামাজে যে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর তার সঙ্গে তুলনীয় একটি জানাজায় আজ আমরা অংশ নিয়েছি। আমাদের বাবাদের প্রজন্ম জিয়াউর রহমানের জানাজা নামাজ পড়েছিলেন, আর আজ আমরা পড়েছি শহীদ ওসমান হাদীর জানাজা নামাজ।
উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি জানাজা নামাজে যে উপস্থিতিকে সর্বোচ্চ বলা যায়- ঠিক সেই পরিমাণ মানুষই উভয় সম্মানিত মানুষের জানাজা নামাজে উপস্থিত হয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এমন এক সময়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যখন দেশটি মাত্র কয়েক বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। তখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঘিরে পূর্ণাঙ্গ কালচারাল ফ্যাসিজমের স্ট্রাকচার বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। কিন্তু তিনি এর সম্ভাব্য ভয়াবহতা অনুধাবন করেছিলেন। তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি সংস্কৃতিকে বেন্ডিং করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শ নির্মাণ করেন। যে আদর্শ গত চার দশক বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের মানচিত্র, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার লড়াই চালিয়ে গেছে।
আরও পড়ুন : ‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ থেকে শহীদ শরিফ ওসমান হাদি’
এদেশের রাজনৈতিক ফ্যাসিজমের মূল ভিত্তি হলো কালচারাল ফ্যাসিজম, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আধিপত্যবাদের মোড়কে প্রচার ও প্রসার হয়। এই কালচারাল ফ্যাসিজম এদেশের মুসলমানদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ডেমোনাইজ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিকাশকে হীনমন্যতার শৃঙ্খলে আটকে দিতে পারা শত্রুপক্ষের জন্য এক বড় সাফল্য।
এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি রাজনৈতিক হেজিমনি ভাঙার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন, ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সীমাহীন চেষ্টা সাধনা করেন। কিন্তু বুলেটের আঘাতে এদেশের মানুষের প্রিয় শাসকের অকাল মৃত্যু ঘটে। অফুরন্ত ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেন।
এই দলটি নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এগিয়েছে। কিন্তু আদর্শিক জায়গায় আর্গানিক নেতৃত্ব তৈরি না হওয়া এবং রাজনৈতিক নার্সিং দুর্বল হওয়ার কারণে অনেকেই দলে ঢুকেছে, যারা দলের মূল ভিত্তি তথা মুসলিম জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে দলকে সরিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের স্বার্থে দলকে ব্যবহার করছে। এর পরিণতিতে দলটি মানুষের ভালোবাসার জায়গা থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরে গেছে।
ঠিক এই সময়ে কিংবদন্তির মতো আবির্ভূত হন শহীদ ওসমান হাদী। তিনি সরাসরি আঘাত করেন কালচারাল ফ্যাসিজমের ভিত্তিতে। এই ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে তিনি তৈরি করেন ইনকিলাব মঞ্চ ও ইনকিলাব সেন্টার। ঘুণে ধরা রাজনীতিকে শোধরাতে তিনি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন এবং অল্প সময়েই তার ট্রায়াল দেখান। তার রাজনীতির মূলে ছিল বিদ্যমান রাজনৈতিক কালচার ভেঙে দেওয়া।
ফজরের নামাজের পর তিনি মানুষের দারে দারে গেছেন। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থে বলা চলে খালি হাতে রাজনীতি শুরু করেছেন। জনগণের ইশতেহারকে নিজের ইশতেহার বানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন- মানুষের ইশতেহার মানুষ নিজেই লিখবে। মাঠে-ঘাটে নেমেছেন, ছোট একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন। তিনি কোনো দলে যুক্ত হননি, আবার নিজে কোনো দলও গড়েননি। ভোটের মাঠে নেমে দেখিয়েছেন কীভাবে ভোটের রাজনীতি করতে হয়।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি কালচারাল সেন্টার গড়ে তুলেছেন। ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পথ চলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি আপোষহীন অবস্থান নিয়েছেন, কারণ তিনি দেখেছিলেন- দেশের নেতৃত্বের একটি অংশ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করতে প্রস্তুত। তিনি কঠিন অবস্থান বেছে নিয়েছিলেন। পরিণতিতে তাকে হত্যা করা হয়, শহীদ করা হয়।
১২ ডিসেম্বর তিনি গুলিবিদ্ধ হন, ১৮ ডিসেম্বর শাহাদাত বরণ করেন। আর আজ, ২০ ডিসেম্বর, মিলিয়ন মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার দৃশ্য দেখে অনেকে আত্মতৃপ্তি অনুভব করছেন, ইনসাফের বাংলাদেশের কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে হবে।
১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে যারা হত্যা করেছিল, সেই কুশীলবদের অনেকেই তাঁর জানাজায় উপস্থিত ছিল। মায়াকান্নায় মানুষ গলে গিয়েছিল। জিয়ার আদর্শ ধারণ করে দেশ চালানোর অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বোঝা যায়- তারা আধিপত্যবাদের সহযোগী। দীর্ঘ সময় তারা আধিপত্যবাদকে সার্ভিস দিয়েছে। বিএনপিকে মোকাবিলার জন্য নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করেছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার পেতে এই দেশের মানুষকে আরও দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
শহীদ ওসমান হাদীর জানাজা নামাজে মিলিয়ন মানুষের উপস্থিতি দেখে আত্মতৃপ্ত হবেন না। তাদের পরিকল্পনা আরও বড় হবে, আরও গভীর হবে। বড় পরিকল্পনা মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। আপনি কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন- আজকের জানাজায় শহীদ ওসমান হাদীর হত্যাকারীদের কুশীলবরা উপস্থিত ছিল না?
শহীদ ওসমান হাদী যে পথে হেঁটেছেন, সেই পথ অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ। তবে আমি বিশ্বাস করি- তিনি যে শাহাদাতের তামান্না ও ইনসাফের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দিয়ে গেছেন, তা কেউ নির্বাপিত করতে পারবে না। শহীদ ওসমান হাদীর হত্যার বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করতে হবে।
একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারই এদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করবে। সেই ভবিষ্যতে শহীদ ওসমান হাদীর চিন্তা প্রসারিত হবে, ইনশাআল্লাহ। একটি গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের মানুষের মানসপট বুঝতে হবে।
ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হোক শহীদ ওসমান হাদীর রেখে যাওয়া কাজের ধারাবাহিকতা। সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় প্রত্যেককে হাদীর চিন্তা ও কর্ম গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, ইউটিএল