ডিজিটাল প্রতারণার ছায়ায় জাতীয় নির্বাচন: ভুয়া পোস্টার ও এআই ভিডিও চ্যালেঞ্জে প্রশ্নের মুখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
- ব্যারিস্টার সাঈদ বাকি
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:২০ PM
বাংলাদেশ যখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখন নির্বাচনী পরিবেশে এক নতুন ধরনের প্রযুক্তিগত হুমকি স্পষ্ট হয়ে উঠছে—যা পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও শক্তিশালী, দ্রুত এবং বিপজ্জনক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি ভুয়া পোস্টার, বিকৃত প্রচারণা সামগ্রী এবং অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এআই ভিডিও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একসময় যেখানে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য মানুষকে মিথ্যা প্রচারের ওপর নির্ভর করতে হতো, এখন সেখানে কয়েক সেকেন্ডের এআই টুলেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে এমন কনটেন্ট, যা সাধারণ ভোটার সহজে সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারছেন না।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম—বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ও হোয়াটসঅ্যাপ—ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে দ্রুতগতির মাধ্যম হয়ে উঠেছে। মানুষের হাতে স্মার্টফোন পৌঁছানোর ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, ভুয়া পোস্টার বা এআই ভিডিও তৈরি করা যেমন সহজ, তেমনি সেগুলো মুহূর্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং সামগ্রিকভাবে নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে।
গণতন্ত্রের একটি মৌলিক ভিত্তি হলো জনগণের তথ্য জানার অধিকার—যা সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করে। কিন্তু যখন ভোটাররা আর বুঝতে পারেন না কোনটি আসল এবং কোনটি এআই–নির্মিত, তখন গণতান্ত্রিক জবাবদিহি দুর্বল হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন প্রার্থীর নামে এআই ভিডিও বানিয়ে এমন কথা বলানো হতে পারে—যা ওই প্রার্থী কখনও বলেননি। কিংবা কোনো দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভুয়া এআই পোস্টার ছড়ানো হতে পারে, যা মানুষের রাজনৈতিক মনোভাবকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
এই চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটির একটি বড় অংশই এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা কনটেন্ট যাচাই করতে অভ্যস্ত নয়। এআই প্রযুক্তি যেহেতু খুব বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে পারে, তাই ভোটাররা এসবকে সত্য মনে করে সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হতে পারেন। এর ফলে নির্বাচনের ওপর আস্থা কমে যায়, এবং রাজনৈতিক বিরোধ অযথা তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এআই–চালিত misinformation–এর ক্ষতিকর প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছে এবং তারা নানা উপায়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা করেছে।
ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নামে এআই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এআই–নির্মিত বক্তব্য এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে তা আসল মনে হওয়া স্বাভাবিক। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (ECI) দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ডিজিটাল মনিটরিং সেল চালু করে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাধ্য করা হয় ভুয়া কনটেন্ট দ্রুত অপসারণের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারদের উদ্দেশ্যে এআই–নির্মিত ভয়েস কল ছড়ানো হয়, যাতে বলা হয়েছিল ভোট না দিতে। এই ঘটনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সরাসরি দুর্বল করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। ফলে ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (FCC) এআই–নির্মিত রাজনৈতিক রোবোকল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনলাইন misinformation নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করেছে। DSA অনুসারে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ভুয়া তথ্য দ্রুত অপসারণ করতে হবে এবং রাজনৈতিক কনটেন্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে—যেমন এআই দিয়ে তৈরি হলে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে।
এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। বিশ্বে যেসব ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে, বাংলাদেশও সেগুলো অনুসরণ করে একটি প্রযুক্তি–সহনীয়, নিরাপদ ও স্বচ্ছ নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে থাকেন। ফলে যে কোনো ভুয়া পোস্টার বা এআই–নির্মিত ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতির পেছনে বেশ কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনেক ব্যবহারকারীরই ডিজিটাল তথ্য যাচাইয়ের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই; তারা প্রাপ্ত তথ্য যাচাই না করেই বিশ্বাস করেন এবং দ্রুত অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় সামান্য তথ্যও বড় ধরনের বিভ্রান্তি বা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা misinformation–কে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তৃতীয়ত, বর্তমান আইনগত কাঠামো এখনো এআই ভিডিও বা উন্নতমানের ডিজিটাল বিভ্রান্তি মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, ফলে এই ধরনের অপরাধ দ্রুত চিহ্নিত ও দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে। চতুর্থত, দলীয় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়ায় তথ্যযুদ্ধের অংশ হিসেবে পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ই কখনও কখনও ভুয়া কনটেন্টের আশ্রয় নিতে পারে। এসব কারণ মিলিয়ে এআই–চালিত misinformation শুধু নির্বাচনী স্বচ্ছতা ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং দেশের সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমত, একটি রিয়েল-টাইম ডিজিটাল মনিটরিং সেল গঠন অত্যন্ত জরুরি, যেখানে এআই টুল ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত সন্দেহজনক কনটেন্ট দ্রুত শনাক্ত, বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনে অপসারণ করা হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলের অফিসিয়াল প্রচারণা উপকরণে কিউআর (QR) কোড বা ওয়াটারমার্ক বাধ্যতামূলক করলে যে কোনো পোস্টার, ভিডিও বা বার্তার সত্যতা সহজেই যাচাই করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, মেটা, ইউটিউব, টিকটকসহ প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা চুক্তি করা জরুরি, যাতে ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট দ্রুত অপসারণের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগত সময়সীমা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, জনগণের ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি করাও এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে ভোটারদের misinformation শনাক্ত ও যাচাই করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা স্বাধীন ও সত্য তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকে জনগণের আস্থা, সত্য তথ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর। কিন্তু এআই–নির্ভর ভুয়া পোস্টার, ভিডিও ও তথ্যপ্রবাহ সেই ভিত্তিকে দুর্বল করছে। তাই প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে রক্ষা করা কেবল নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নয়—এটি রাষ্ট্রের সার্বিক সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার একটি জাতীয় কর্তব্য। বাংলাদেশ যেন একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল প্রতারণার শিকার না হয়—তা নিশ্চিত করতে এখনই শক্তিশালী, সুসমন্বিত এবং আধুনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।