যে কারণে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে আমরা মনে রাখব

ড. কাবেরী গায়েন
ড. কাবেরী গায়েন  © টিডিসি সম্পাদিত

ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক এবং বাংলা ভাষার আন্দোলন, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি-জাতিসত্তার অন্বেষণে নিবেদিত এক মনীষী আহমদ রফিকের জীবনাবসান হয়েছে। ৯৬ বছরের দীর্ঘজীবনে তিনি লিখেছেন কবিতা, মননশীল প্রবন্ধ এবং গবেষণাগ্রন্থ, ছোটগল্প, অনুবাদ, বিজ্ঞানের বই। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যপত্রিকা, মেডিকেল জার্নাল। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। সম্পাদনা করেছেন বাংলা একাডেমির চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা কোষ। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন তিনি। বিশেষ করে ‘আদি মানবের সন্ধানে’ (১৯৮৯), ‘এই পৃথিবীতে মানুষ’ (১৯৯৯) বই দুটো নৃতাত্ত্বিকতার প্রথম পাঠ হিসেবে কিশোরদের জন্য খুব কাজের বই। খুব সহজ ভাষায় লেখা।

তবে আহমদ রফিক যে বইগুলোর জন্য অনন্য সেগুলো কয়েকটা ভাগে দেখা যেতে পারে। লজ্জিতভাবে স্বীকার করি, উনি ১০/১২টি কবিতার বই লিখলেও কোনো কবিতার বই আমার পড়া হয়নি। আমাদের দেশে কেউ একবার কোনো বিষয়ে দক্ষতা দেখিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, ওই পরিচয়েই আমরা দেখতে অভ্যস্ত।

আমি স্যারের প্রবন্ধ এবং মননশীল বই পড়েই চিনেছি ওনাকে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে ধারাবাহিক লিখেছেন তিনি। ‘একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস’ (১৯৮৮), ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য’ (১৯৯১), ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা’ (১৯৯৩) এবং ‘ভাষা আন্দোলন : গ্রাম : কৃষি ও কৃষক’ (২০০২)। শেষের বইটি আমার সবচেয়ে প্রিয়—এক কারণে যে আমার নিজেরও ধারণা ছিল ভাষা আন্দোলন শহরের আন্দোলন যেখানে সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। আহমদ রফিকের এই বই দেখিয়েছে ভাষা আন্দোলন কেন আমাদের গ্রামের মানুষের জন্যই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রামের মানুষের কৃষিব্যবস্থা, জীবনাচরণের সঙ্গে মাতৃভাষার সংযোগ কোনো আরোপিত ব্যাপার নয়, তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। শহুরে মানুষ হয়তো অন্য ভাষা আয়ত্তেও আনতে পারতেন, কিন্তু কৃষিমুখী গ্রামীণ অর্থনীতি এবং কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি মাতৃভাষা ছাড়া মূল্যহীন। যারা জনমানুষের জন্য রাজনীতি করেন, বিশেষত তরুণরা, এই বইটি অবশ্যই পড়া দরকার তাদের। বইটা তিনি পরিণত বয়সে লিখেছেন, আমারও পরিণত বয়সে পড়া।

স্যারের লেখা ও চিন্তার একটা বড় অংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। কলকাতার টেগোর রিসার্চ সেন্টার তো সম্ভবত ওনাকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ খেতাবও দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উপরে অনেক বই তিনি লিখেছেন। আমি মাত্র দুটো পড়েছি। পাঠক হিসেবে আলস্য ক্ষমাহীন। বই দুটোর একটি হলো ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ’ (১৯৮৭), দ্বিতীয়টি ‘রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম : কৃষি ও কৃষক’ (২০০২)। আমি দ্বিতীয় বইটির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী, কারণ আমার পিএইচডি এবং পোস্টডক গবেষণায় মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ এবং এই যোগাযোগ কীভাবে তার সামাজিক মূলধন হিসেবে কাজ করে, সেসব দেখতে গিয়ে মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের গ্রাম-সমবায়ের কথা। দেশে মাঠ-উপাত্ত যোগাড় করতে এসে স্যারের এই বইটা পেলাম। আমি যে অর্থে সোশ্যাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক মূলধন পড়ি বা ব্যবহার করি সেইসব শব্দের ব্যবহার নেই এই বইতে, কিন্তু আমার ধারণার কাছাকাছি মনে হয়েছে এই বই। খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম।

তবে যে বইয়ের জন্য আমি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ, সেটা হলো ‘একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য’ (২০০১)। বইটা এখন আরো বেশি দরকার তরুণ প্রজন্মের জন্য, যারা নানা জনের কাছে নানা উচ্চকিত সবক নিয়ে ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে শুরু করে গোটা মুক্তিযুদ্ধকেই তাচ্ছিল্যকরণের কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন। আহমদ রফিক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। উচ্চস্বরে কোথাও নিজেকে জাহির না করেও তিনি নির্মোহ চর্চাকারী। তাঁর বয়ানকে আওয়ামী ন্যারেটিভ বলে ফেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। আমার বিভাগের যারা সাংবাদিকতায় আছেন, যাচ্ছেন, তারাই যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নির্মোহ ভাষ্য তৈরি করেন, করবেন, এই বইটা পড়ে নিতে পারেন।

আহমদ রফিকের স্কলারশিপের সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়টি নজর কাড়ে তা হলো তাঁর বিনয়। নিজেকে জাহির করার জন্য অন্যকে ছোট করা, সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানোর কোনো অপকৌশল কোনোদিন তাঁকে নিতে হয়নি। তিনি কোনো অসূয়ায় ভোগেননি কারো প্রতি, নিজেকে জাঁকালো করে উপস্থাপনের কোনো ইঁদুর দৌড়ে অংশ নিতে দেখা যায়নি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর লেখা কতটা পৌঁছেছে বা আদৌ পৌঁছেছে কি না জানা নেই। না পৌঁছানোটা ক্ষতিকর।

স্যারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। একবার ছাত্র ইউনিয়নের এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল নব্বই দশকের শুরুর দিকে, শিক্ষার্থী অবস্থায়। আরেকবার টেলিভিশনের কোনো এক অনুষ্ঠানে। খুব জমকালো কথা বলে রাজাউজির মারার মানুষ নন তিনি। বরং মৃদুভাষী। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, আহমদ রফিকদের বিনয় তাদের একটা ঘরানায় ফেলে। এই ঘরানাটা অর্গানিক বামপন্থার—সত্যেন সেন, রণেশ দাসগুপ্তরাও এই বিনয়ী ঘরানার। সেটা হলো স্কলার হয়েও বিনয় ছাড়েননি তারা; বরং বিদ্যা বিনয় দান করে—এই সত্যকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। পাণ্ডিত্যের উপরে দেশ ও জাতিসত্তার অন্বেষণে স্যারের নিবিড় মনোযোগ ও অনুভব প্রধান হয়ে উঠেছে।

স্যারের মৃত্যুতে শোক, শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই।

ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ